৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১১:০৬

ভোটের আগে বাড়ছে বিদেশিদের চাপ

জাতীয় সংসদ নির্বাচনপূর্ব রাজনীতি অনেকটাই কূটনীতির পরিমণ্ডলে আবর্তিত হচ্ছে। বিদেশি কূটনীতিকদের সক্রিয় তৎপরতায় সৃষ্ট বাতাবরণের মধ্যে ভোটের আগের রাজনীতি বাংলাদেশে নতুন নয়।

তবে এবারের পরিবেশ আগের নির্বাচনপূর্ব রাজনীতির সঙ্গে মেলানো যায় না। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণা করার পর পরিস্থিতি দ্রুত পালটে যায়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে একের পর এক প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ দিতে থাকেন।

সেপ্টেম্বর মাসে চাপ আরও ঘনীভূত হচ্ছে। নির্বাচনের সঙ্গে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে যুক্ত করছে ওয়াশিংটন। চলতি সেপ্টেম্বরে ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যবিষয়ক সংলাপ টিকফা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেও শ্রম অধিকারসংক্রান্ত কমপ্লায়েন্সের চাপ আসতে পারে। অক্টোবরের শুরুতে আসবে মার্কিন নির্বাচনি পর্যবেক্ষক মিশন।

নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বৃদ্ধির মধ্যে ঢাকা সফর করছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। আজ সকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। রাজনীতি নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের কোনো বার্তা তিনি শেখ হাসিনাকে দেন কিনা সেটা নিয়েও কূটনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্র যখন চাপ দিচ্ছে তখন রাশিয়ার বার্তা মার্কিন অবস্থানকে নমনীয় নাকি আরও কঠোর করবে সেটা সামনে আরও স্পষ্ট হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সময়টায় খুব ব্যস্ত। শুক্রবার সকালে লাভরভের সঙ্গে বৈঠকের পর দিল্লি উড়ে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। জি-২০ এর সদস্য না হলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগতিক ভারত বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
মোদির সঙ্গে সাইডলাইন দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুই দেশের সহযোগিতার আলোচনায় দুই নেতার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা হওয়াই স্বাভাবিক। ২০১৪ সালে একতরফা এবং ২০১৮ সালে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও প্রত্যাশিত ফল পায়নি। উভয় নির্বাচনে শেখ হাসিনার পাশে ছিল দিল্লি। এবারও একই অবস্থানের কথা শোনা যাচ্ছে। যদিও পর্দার আড়ালে কী হয় সেটা বোঝা কঠিন।
বাংলাদেশের কূটনীতিকরা এখনো স্পষ্ট করে কিছুই বলতে পারছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশের এক সাবেক রাষ্ট্রদূত যুগান্তরকে বলেন, ‘এবারের পরিস্থিতি বোঝা যাচ্ছে না।’ অন্য একজন কূটনীতিক বলছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে পরিস্থিতি সামলে নেওয়া সম্ভব হবে। গুলশান-বারিধারার কূটনৈতিক পার্টিগুলো রাজনীতির আলোচনায় সরগরম।

তেমনি এক আড্ডায় এক কূটনীতিক বলেন, ‘ড. ইউনূসকে এতটা হাইলাইটে আনার দরকার কি!’ যদিও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সরকার দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরানোর লক্ষ্যে ইউনূস ইস্যু সামনে নিয়ে এসেছে।’

‘ইউনূস ইস্যুতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনসহ ১৬০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিবৃতিকে অস্থিরতা সৃষ্টির প্রয়াস বলে মনে করছে সরকারি মহল। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই লাভরভের সফরের বার্তা সম্পর্কে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এক কূটনীতিক বলেন, এটা সরকার কতটা কীভাবে নেবে সেটা সম্পূর্ণই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। কারণ এতে যুগপৎ স্বস্তি ও ঝুঁকির দিক রয়েছে।

ঢাকায় মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও শার্ন্তিপূর্ণ নির্বাচন চান। আপাতত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা তারা বলছেন। যদি বিএনপি অংশ না নেয় তবে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলা হবে কিনা জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা বলেন, এটা সিদ্ধান্ত হবে অক্টোবরে যখন নির্বাচন পর্যবেক্ষক মিশন আসবে।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক মিশন অনেকটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-পর্যবেক্ষক মিশনের মতোই হবে। তারা বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে মার্কিন এক বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি বলেছেন, ভোটে বিএনপি অংশ না নিলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন হবে। সাধারণভাবে মনে করা হয়, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়বে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সফরে সরকারের আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি উৎক্ষেপণ করলেও এবার বঙ্গবন্ধু-২ উৎক্ষেপণ করবে ফ্রান্স। কী বিবেচনায় এবার ফ্রান্সের সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে সেটা বোঝা কঠিন। এর প্রভাবই কী হবে সেটা এখনই স্পষ্ট হচ্ছে না।

বাইডেন প্রশাসন স্পষ্টত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ দিচ্ছে। যদিও কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশকে চীনের আধিপত্যের প্রভাবমুক্ত রাখতে ভূরাজনৈতিক স্বার্থে বাইডেন প্রশাসনের চাপ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সাম্প্রতিক আলোচনায় ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির প্রতি জোর দিচ্ছে ওয়াশিংটন।

বাংলাদেশের সঙ্গে ‘আকসা’ ও ‘জিসোমিয়া’ নামের দুটি পৃথক চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন অবশ্য বলছেন, নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো চুক্তিতে সই করবে না বাংলাদেশ। তবে ভবিষ্যতে চুক্তিগুলো সই করার আশ্বাস দেওয়া আছে। বাংলাদেশ বিষয়টা খতিয়ে দেখছে।

রাজনীতিতে শেখ হাসিনা একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনের নীতি নিয়েছেন। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন হয়েছে। মেট্রোরেলের মতিঝিল পর্র্যন্ত কার্যক্রম আগামী মাসে চালু হবে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল নির্মিত হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর নিচে।

আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে আরিচা সড়কের হেমায়েতপুর থেকে আরও একটি মেট্রোরেলের উদ্বোধন করবেন। তার বিপরীতে বিএনপি বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে দলকে চাঙা করছে। নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর বিএনপি সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের ঘোষণা দেবে। তবে সবার নজর কূটনৈতিক পরিস্থিতির দিকে। রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে কূটনীতিকে ঘিরে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/715610