৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১০:১৯

বরাদ্দ ৮ হাজার কোটি টাকার বেশির ভাগই নয়-ছয়

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা : অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দরপত্র ছাড়াই পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া, সাব-ঠিকাদারদের মাধ্যমে কাজ করানো, অপ্রয়োজনীয় স্থানে সংস্কারসহ নানা কারণে উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে সরকার নেওয়া প্রকল্প কাজে আসছে না। হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও কাজের কাজ তেমন না হওয়ায় বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের নামে প্রতি বছরই কোনো না কোনো প্রকল্প হাতে নিচ্ছে পাউবো। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মতে উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে সরকারের দেয়া বরাদ্দের ৮ হাজার কোটি টাকার চারটি প্রকল্পের কাজ শেষের পথে। এরমধ্যে সাতক্ষীরা ও খুলনা উপকূলে ৪ হাজার কোটি টাকা কাজ নানা অনিয়মের মধ্যে চলছে। শুধু গাবুরা ইউনিয়নটির চারিপাশে উপকূলীয় টেকসহ বেড়িবাঁধ নির্মাণে ১ হাজার ২০ কোটি ৪২ লাখ টাকার কাজ চলছে। সাতক্ষীরা পানিউন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দীন জানান, সরকার গাবুরা ইউনিয়নে চারিপাশে সাড়ে ২৯ কিলোমিটার টেকসই বাঁধ নির্মাণে ১ হাজার ২০ কোটি ৪২ লাখ টাকা বরাদ্দ বালি ভর্তি জিও ব্যাগ নদীতে ফেলে নদী ভাঙন রক্ষা, পাথর, বালি এবং সিমেন্ট জমিয়ে সিসি ব্লক তৈরি করে বেড়িবাঁধের নদীর পাশে বসিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে কংক্রিটের টেকসই বেড়িবাঁধটির নির্মাণ কাজ ।

বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ওপর একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তাতে উঠে আসে স্থানীয় জনগণকে উপেক্ষা করে প্রভাবশালীদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি; যেখানে প্রভাব খাটান মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, ক্ষমতাসীন দলের নেতা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা। সবার সঙ্গেই ‘সুসম্পর্ক’ পাউবো কর্মকর্তাদের। এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাঁধ নির্মাণ বা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এতে সাধারণ জনগণের ক্ষতি প্রশমনের চেয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যটাই বেশি থাকে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িতদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। আমাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনে এসব চিত্র অনেকবার উঠে এসেছে। ফলে এসব কাজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের পাশাপাশি যারা পেছনে থাকেন এবং যোগসাজশ করেন তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’

দাতা সংস্থা ও জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো পরিদর্শন করে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ দুর্যোগের ঝুঁকি কমাতে বেশ কিছু পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শের আলোকে পুরনো বাঁধ সংস্কারের পাশাপাশি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে এক হাজার ২৩ কোটি টাকার ‘সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার নম্বর-১৫ পুনর্বাসন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প ২০২১ সালে এবং ২০২২ সালে এক হাজার ১৭২ কোটি ৩১ লাখ টাকার খুলনার ‘কয়রা উপজেলার পোল্ডার নম্বর-১৪/১ পুনর্বাসন’ শীর্ষক আরেকটি প্রকল্প এবং একই বছরে উপকূলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে ৯৬১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে পাস হয়। এই মেগাপ্রকল্পগুলোর পাশাপাশি বেশকিছু ছোট ছোট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ওই সকল প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কাজে ধীরগতি ও স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

সাতক্ষীরা পাউবো এর অধীনে কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া ও কয়রার তিনটি নদ-নদীর ১২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কারের নামে বিগত ১০ বছরে খরচ দেখানো হয়েছে ১৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৮ হাজার টাকারও বেশি। জোড়াতালিতেও বাঁধ সংস্কারের নামে যেটুকু কাজ হয়, সেখানেও রয়েছে অর্থ লুটপাটের অসাধু চক্র। এ বছরও তা-ই হচ্ছে। পাউবোর বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে উপজেলার দুটি পোল্ডারে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ১৮টি স্থান নির্ধারণ করা হয়। এগুলো মেরামতের জন্য সরকার ৪ কোটি ৮৩ লাখ ৬২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু কোনো দরপত্র ছাড়াই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি স্থানের কাজ পেয়েছেন যশোরের কেশবপুরের প্রতিষ্ঠান তানিয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক আব্দুল মতিন। বাকিগুলোর মধ্যে চারটি স্থানীয় ঠিকাদার মোজাফ্ফর হোসেন এবং দুটি স্থানের কাজ পান সিরাজউদ্দৌলা লিংকন ও খলিলুর রহমান নামে দুই ঠিকাদার।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, দেশের ১৩ জেলায় ষাটের দশকে ৫ হাজার ৮১০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকায় ১৩৯টি পোল্ডার বা বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে স্বাধীনতার ৫২ বছরে নতুন আর কোনো পোল্ডার তৈরি হয়নি। পাকিস্তান আমলের এসব বাঁধ সংস্কার আর পুনঃনির্মাণেই কেটে গেছে অর্ধশত বছর। এগুলোর নকশাও সেই মান্ধাতা আমলের। উচ্চতা মাত্র ১০ ফুট। অথচ আমফানসহ সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস বয়ে এসেছে ১২-১৫ ফুট ওপর দিয়ে। ফলে ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল রেখার প্রায় ১৫ হাজার বর্গকিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা এখনো অরক্ষিত। জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগকে মাথায় রেখে স্থায়ী ও মজবুত বেড়িবাঁধ নির্মাণ করার লক্ষে সরকার শুধুমাত্র ১৪ নং পোল্ডারে ৯৫৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকার প্রকল্পের কাজ চলছে।

এতে করে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে দুর্যোগের কারণে লক্ষ লক্ষ মানের জীবন-জীবিকার ঝুঁকি বেড়েছে। যে কারণে সাধারণ মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ উপকূলীয় অঞ্চলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার প্রধানমন্ত্রীর সেই ঘোষণা এবং সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো গৃহীত প্রকল্পগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় উপকূলীয় জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কর্মসংস্থানের অভাবে স্থানীয়রা এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।

সাতক্ষীরা ৪ শ্যামনগর এলাকার সংসদ সদস্য এসএম জগলুল হায়দার জানান, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে দ্বীপ ইউনিয়নের মানুষের জান, মাল ফসলি জমি, মাছের ঘেরের ক্ষতি হবেনা ছাড়তে হবে না জন্মস্থানের বসত-বাড়ি। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুন্দরবন উপকূলীয় গাবুরা ইউনিয়নে মানুষের রক্ষায় টেকসহ এ বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে দিচ্ছেন। উপকূলের মানুষ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।

https://www.dailysangram.info/post/534807