৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৬:২৪

ডলার সংকট আরো প্রকট হচ্ছে

খোলা বাজারে ডলারের সংকট আরো প্রকট হচ্ছে। ব্যাংক ও খোলা বাজারে ডলারের বিনিময় হারের পার্থক্য বেড়ে দাড়িয়েছে প্রায় ৭ টাকার মত এর ফলে বাড়ছে হুন্ডি। এলসির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার পাচ্ছে না ব্যবসায়ীরা। একদিকে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন শিক্ষা, চিকিৎসা বা অন্য প্রয়োজনে বিদেশগামীরা। অন্যদিকে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমছে। আগামীতে ডলার সংকট আরও বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা।

জানা গেছে একদিকে দেশ থেকে নানাভাবে আমদানির নামে টাকা (ডলার) পাচার হচ্ছে অন্যদিকে খোলা বাজারে ডলারের দাম বেশি হওয়ার কারণে হুন্ডি বাড়ছেই। কোনভাবে হুন্ডি থামানো যাচ্ছে না।

সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো ব্যাপক নজরদারি, নিয়মিত অভিযান পরিচালনা, নানা প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ব্যাংকিং লেনদেনে কড়াকড়ি আরোপ করেও নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে হুন্ডিবাণিজ্য। দীর্ঘদিন ধরে অর্থ পাচার ব্যক্তিপর্যায়ে থাকলেও কয়েক বছর ধরে ভয়ংকর এ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন বড় প্রতিষ্ঠান। নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আদালত অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাজার রায় দিলেও নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে দেশের অর্থনীতির মেরুদ- দুর্বল করে দিচ্ছে এই হুন্ডিচক্র।
দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক বলেন, দুর্নীতিবাজরা অনেক শক্তিশালী। তারা বড় বড় আইনজীবী নিয়োগ করে উচ্চ আদালতে মামলা ‘স্টে’ করিয়ে রাখছেন।

জানা গেছে, আমদানির নামে প্রতিবছর ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। কোনভাবেই এ পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না। এতে করে ডলার সংকট আরো প্রকট হচ্ছে। প্রায় ছয় মাস ধরে তদন্তের পর শুল্ক গোয়েন্দারা এটি শনাক্ত করলেও এই পাচারের ঘটনা ঘটেছে বহু বছর ধরে। এই অর্থপাচারের সঙ্গে একাধিক চক্র জড়িত বলে কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, যাদের মধ্যে অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির যোগসূত্রও তারা পেয়েছেন।

এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে আরও গভীর ও বিস্তৃত তদন্ত সাপেক্ষে অনুকম্পা বা ভয়ের ঊর্ধ্বে থেকে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহি নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে।

গতকাল বুধবার সরকারি ছুটি হওয়ায় অধিকাংশ মানি চেঞ্জার বন্ধ ছিল। রাজধানীর পল্টন এলাকা ঘুরে কয়েকটি মানি চেঞ্জার হাউস খোলা দেখা যায়। এসব হাউসে স্বল্প পরিসরে বিদেশি মুদ্রা কেনা-বেচা হচ্ছে। গতকাল খোলা বাজারে ১১৭ টাকা থেকে ১১৭ টাকা ৭০ পয়সায় ডলার বিক্রি হয়েছে। যেখানে মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোয় প্রতি ডলার ১০৯ টাকা ১০৯ টাকা ৬০ পয়সায় বিক্রি হচ্ছিলো।
তবে মানি চেঞ্জাররা বিদেশি মুদ্রার একটি মূল্য তালিকা করেছেন। সেখানে ডলার বিক্রির দাম ১১২ টাকা ও কেনার দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে নিজেদেরই তৈরি করা বিদেশি মুদ্রার এই দাম সবাই মানছে না।

সম্প্রতি নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনাবেচা করায় সাত মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি একই কারণে আরও দশ মানি চেঞ্জারের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সময়ে বেশি দামে ডলার বেচাকেনার অভিযোগে ১৩ ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তলব করা ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতের। এর মধ্যে একটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক রয়েছে।

এদিকে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) নির্ধারিত দামে ব্যাংকগুলো ডলার কেনা-বেচা করছে। তবে এরমধ্যেই ডলারের খোলা বাজারে দাম বেড়ে এই নতুন অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, এবিবি ও বাফেদা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে প্রতি মাসে ডলারের দাম নির্ধারণ করে। এরই ধারবাহিকতায় গত ১ আগস্ট তারা রেমিট্যান্সের বিনিময় হার ১০৯ টাকা নির্ধারণ করে। আমদানিকারকদের জন্য প্রতি ডলার ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা ও রপ্তানিকারকদের জন্য ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশে ব্যাপকহারে ডলার সংকট দেখা দেয়। পাশাপাশি কমতে থাকে প্রবাসীদের পাঠানো ডলারের পরিমাণ। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে থাকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় বিদেশি মুদ্রার বাজার গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী আগস্ট মাস শেষে দেশের রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৩০৬ কোটি ডলার। এটি রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের আগের সময়ের তুলনায় অনেক কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ব্যাংকগুলোর হাতে সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার রয়েছে। বর্তমান বাজার চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত হওয়ার কথা। সেইসঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।

এর পরও কেন ব্যাংকে ব্যাংকে ডলারের সংকট হচ্ছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র জাকির হোসেন চৌধুরী বলেন, সবাই যদি ব্যবসায়ী হয়ে যায় তাহলে তো ডলারের দাম বাড়বেই। রপ্তানিকারকরাও ডলারের ব্যবসা শুরু করেছে। আর সবাই যদি সেই ডলারের পেছনে ছুটে ডলার সংকট তো হবেই। এটা আসলে সুস্থ পরিস্থিতি না।

তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকে এখন প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন নগদ ডলার রয়েছে। এ কারণে সংকট তৈরির কোনো কারণ নেই। ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে ডলারের ব্যবহার করছে কি না, সেই বিষয়ে যাচাই-বাছাই করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি রাখায় গত রোববার ১৩টি ব্যাংকের কাছে প্রাথমিকভাবে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোর ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতদিন বাজারে ডলারের অনেক দর প্রচলিত ছিল। মঙ্গলবার থেকে সব ক্ষেত্রে একক দর কার্যকর হয়েছে। ফলে এখন রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ডলারের একই দর হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে এই ব্যবস্থা কার্যকর করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় থেকে আসা ডলারের দর হবে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। আগে ব্যাংকগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতি ডলারের জন্য প্রবাসীদের ১০৯ টাকা এবং রপ্তানিকারকদের ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা দিত। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো এখন আমদানিকারকদের কাছে ১১০ টাকায় ডলার বিক্রি করবে। আগে আমদানি দায় মেটাতে ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের কাছে প্রতি ডলার ১০৯ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি করত।

গত জুলাই মাসে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে নির্ধারিত দর না মানার অভিযোগ দেয় বাফেদা ও এবিবি। সংগঠন দুটির যৌথ স্বাক্ষরে গত ৩ জুলাই ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিনিময় হারের একক দর নির্ধারণে বাফেদা ও এবিবি ডলারের যে দর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল গত ২৬ জুন, তা ২ জুলাই থেকে কার্যকর হয়। কিছু ব্যাংক নির্ধারিত সীমার বেশি দরে ডলার কেনাবেচা করছে। যেসব ব্যাংক এটি করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে বলা হবে।

জানতে চাইলে বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম বলেন, প্রতি মাসে বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ডলারের যে দর নির্ধারণ করা হয়, প্রতিটি ব্যাংক সেই দর মেনে চলবে বলে সিদ্ধান্ত রয়েছে। কিন্তু অনেক ব্যাংক তা মানছে না। এ কারণেই বাজার অস্থিতিশীল। বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে দেখছে। যদি সে ধরনের প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রধানত পাঁচ কারণে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট আপাতত দূর হচ্ছে না। এর প্রধান কারন হচ্ছে প্রতি মাসেই দেশ থেকে মোটা অংকের টাকা(ডলার) পাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রচুর অনিষ্পন্ন আমদানি দায় মেটাতে হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাপক আমদানির চাপও রয়েছে। চলতি অর্থবছর বিদেশ থেকে নেওয়া স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধে অনেক অর্থ ব্যয় হবে। বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আসা কমে গেছে। কেউ কেউ মনে করেন, বিদেশে টাকা পাচারও বেড়েছে। এসব কারণে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট সহসাই দূর হচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছে না। এ কারণে মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই ২২৪ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র জিএম তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, ডলার সংকট দূর হওয়া তো দূরের কথা, এখন আরও বেড়েছে। পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের চাহিদামতো এলসি খুলতে চায় না। এ ছাড়া এখন প্রতিটি এলসির জন্য এলসি মার্জিন রাখতে হয়।

https://www.dailysangram.info/post/534791