পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে ৩৭টি পরিবার ভাঙছে। অর্থাৎ প্রতি ৪০ মিনিটে ভাঙছে একটি পরিবার। শুধু পরিবার নয়, দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে দু’টি জীবনের স্বপ্ন। বাড়তি চাপ পড়ছে হঠাৎ বিপর্যস্ত পরিবারের শিশুদের ওপর। তাদের ওপর যে প্রচণ্ড মানসিক যাতনা, যে বোবাকান্না তা কখনো বিচ্ছেদমুখী বাবা-মা ভাবেন কিনা জানি না। ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় জীবনগুলো হঠাৎ কুঁকড়ে যায়। আত্মসমাহিত, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে সমাজ, সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে ফেলে। যে বয়সে শিশুটির অন্যান্য সহপাঠী বন্ধু-বান্ধবদের সাথে হইচই-আনন্দ কোলাহলে সময় কাটানোর কথা; তাতে ছেদ পড়ে। তারা লেখাপড়া বিমুখ হয়ে যায়। নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা বানিয়ে ফেলে। আশ্রয় গ্রহণ করে মাদকের। এভাবেই বিয়েবিচ্ছেদের মাধ্যমে শুধু দু’টি পরিণত জীবনই নয়, বিকাশোন্মুখ জীবনগুলোও ধ্বংস হয়ে যায়।
বিয়েবিচ্ছেদে সবচেয়ে বড় ক্ষতি সাধিত হয় আমাদের জীবনবোধের। শান্তির নীড় নামক পরিবারটির বিনি সুতোর মালাগুলো ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি যা হাজার বছর ধরে আমাদের বেড়ে ওঠার কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে তা এবং পারিবারিক মূল্যবোধ নামক বিশেষণটি খুঁজে পাওয়া যায় না। এভাবেই আমাদের পরিবেশ, সমাজ, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। এমন আশঙ্কা অমূলক নয় সামনের দিনগুলোতে আজীবন সংসার করেছেন এমন দম্পতির দেখা পাওয়া ভার হবে।
বিয়েবিচ্ছেদ আগেও ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা যেরকম আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে, আগে তেমনটি ছিল না। বিবিএসের জরিপ অনুসারে, গত ১৫ বছর ধরে এই হার ঊর্ধ্বমুখী। বিচ্ছেদের জন্য আবেদনকারীদের ভেতর নারীরাই অগ্রণী। ৭০ শতাংশ বিয়েবিচ্ছেদের আবেদনকারী হচ্ছেন নারী। আরো একটি তথ্য বিবিএসের জরিপে উঠে এসেছে। তা হচ্ছে শিক্ষিত দম্পতিদের ভেতর এই হার অবিশ্বাস্য রকমে বেশি। বিয়েবিচ্ছেদ নিয়ে কয়েক বছর ধরে গবেষণা করছেন এমন একজনের মতে সহপাঠীদের বিয়ের ক্ষেত্রে এই হারও আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। অর্থাৎ এখনো পারিবারিকভাবে যে বিয়ের আয়োজন বা ব্যবস্থা তা টিকছে বেশি দিন। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, এক বছরে বিচ্ছেদের হার দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২১ সালে এই হার ছিল প্রতি হাজারে ০.৭ শতাংশ। ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১.৪ প্রতি হাজারে। বিচ্ছেদ ছাড়াই পৃথক বাস করা দম্পতিদের হিসাব ধরলে এ হিসাব কয়েকগুণ বেড়ে যাবে বলে অনুমিত হয়। জরিপে দেখা গেছে, ২৫-৩৯ বছর বয়সী দম্পতিদের মধ্যে বিচ্ছেদের প্রবণতা বেশি। অপর এক জরিপে দেখা গেছে, যে সব পরিবারে ধর্মীয় অনুশাসন পালন করার পরিবেশ রয়েছে সেখানে এই হার ১৫ শতাংশ কম। শহরের ছোট পরিবারের চেয়ে যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবারে বিচ্ছেদের হার তুলনামূলকভাবে কম। ইসলামী জীবনাচারে তালাক একটি সবচেয়ে নিকৃষ্ট গ্রহণীয় পন্থা, এ সম্পর্কে সম্যক ধারণার অভাব মুসলিম সমাজে তালাকের আধিক্যের একটি মৌল কারণ। সমাজে বিয়েবিচ্ছেদের ক্রমবর্ধমান হার সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, বিয়েবিচ্ছেদ মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামীণ জনপদেও। বিয়েবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে বিয়ের এক মাস যেতে না যেতেই বিয়ে ভাঙার ঘটনা যেমন রয়েছে; তেমনি ১৭-১৮ বছরের দাম্পত্য জীবন ভাঙার ঘটনাও কিন্তু কম নয়। এমনকি ৪০ বা তদূর্ধ্ব সময় বৈবাহিক জীবন কাটানোর পরও বিচ্ছেদ ঘটেছে এমন ঘটনারও উদাহরণ রয়েছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত শহর-গ্রাম সর্বত্রই এই সামাজিক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে। যারা সমাজবিজ্ঞানী, সমাজকর্মী, সামাজিক নেতৃত্বে যারা আসীন, তারা এ ব্যাপারে খুব একটা ভাবছেন বলে মনে হয় না। অথচ এই সামাজিক মূল্যবোধধ্বংসী প্রবণতাকে ঠেকানো না গেলে একদিন পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটিই হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারা এবং পরিবার ও বিয়ে নামক সামাজিক প্রথার বিলুপ্তির সাথে সাথে থেমে যাবে। মানব জীবনের, মানবসভ্যতার সৃষ্টিধর্মী প্রবণতার মূল উৎসই হলো সন্তান-সন্ততি। তাদের নিরাপদ ও সমৃদ্ধ জীবনের জন্য মানুষ পরিশ্রম করে, উৎপাদনশীল খাতে সময়, শ্রম ও চেষ্টাকে নিয়োজিত করে। বিয়ের গুরুত্ব এখানেই। বিয়ে ও সংসার জীবন মানবসভ্যতা ও উন্নতির মূল চালিকাশক্তি। সামান্য অজুহাতেই হোক অথবা গুরুতর কোনো কারণেই হোক, যারা বিচ্ছেদের পথে পা বাড়িয়েছেন তাদের জীবনের স্থিতধী আর ফিরে আসে না। এর ভূরিভূরি প্রমাণ আমাদের চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে। বিয়ে একটি বিশ্বাসের ওপর আস্থা রাখার নাম। সুখ-দুঃখ অভাব-অনটন সঙ্কটে একজনের ওপর আরেকজনের গভীর আস্থার প্রকাশ। এই আস্থা এবং বিশ্বাসে যখন একবার চিড় ধরে তা আর ফিরে আসে না। যারা এই বিশ্বাসবোধকে একবার হারিয়ে ফেলেন তারা পরবর্তীতে আর কারো ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। পারস্পরিক বিশ্বাসের ফাটল দিয়ে অবিশ্বাস নিয়তই তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। ফলে পরবর্তীতে ঘর বাঁধলেও আগের নিশ্চিন্ত নীড়ের শান্তি ফিরে আসে না। [১ম কিস্তি]
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com