৩১ আগস্ট ২০২৩, বৃহস্পতিবার

ডাবের চাহিদা বেড়েছে কমছে উৎপাদন

দেশে সাম্প্রতিক সময়ে অন্যান্য নিত্যপণ্যের পাশাপাশি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে ডাবের দাম। মাসখানেক আগেও যে ডাবের দাম ৭০-৯০ টাকা পিস ছিল তা ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় ঠেকেছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের অভিযানেও দাম নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি দেশে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় ডাবের চাহিদা বেড়েছে। চিকিৎসকরা ডেঙ্গু রোগীদের ডাব খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাই বেশি দাম দিয়ে হলেও রোগী বা তাদের স্বজনদের উচ্চমূল্যে বাজার থেকে ডাব কিনে খেতে হচ্ছে। শুধু যে চাহিদা বেড়েছে তা নয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) হর্টিকালচার উইং জানায়, গত পাঁচ বছরে নারিকেলের উৎপাদন কমেছে প্রায় ২৬ শতাংশ। আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে ১৯ শতাংশ।

কমেছে উৎপাদন ও আবাদি জমি
হর্টিকালচার উইং ডাবের আলাদা হিসাব রাখে না। তাদের দেয়া নারিকেলের আবাদ ও উৎপাদনের হিসাবে দেখা গেছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৬ হাজার ৯৬০ হেক্টর জমিতে নারিকেল চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ৬ লাখ ৮৮ হাজার ৬৯১ মেট্রিক টন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছোট বড় সাইজের প্রায় ৮০০ পিস নারিকেল এক টন হয়। সেই হিসেবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নারিকেল উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৫৫ কোটি ৯ লাখ পিস। ক্রমান্বয়ে গত কয়েক বছরে সেটা কমেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৫৩ কোটি ১০ লাখ পিস, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫২ কোটি ৭ লাখ পিস, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫২ কোটি ২৮ লাখ পিস, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪১ কোটি ৫৫ লাখ পিস এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪০ কোটি ৮২ লাখ পিস। একইভাবে গত পাঁচ বছরে নারিকেল আবাদের জমি কমেছে ১৯ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আবাদি জমি ৪৬ হাজার ৯৬০ হেক্টর থেকে কমে ৩৮ হাজার ২২১ হেক্টরে নেমেছে। অর্থাৎ ৮ হাজার ৭৩৯ হেক্টর আবাদি জমি কমেছে। বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরের পরিসংখ্যান এখনো আসেনি হর্টিকালচার সেন্টারের কাছে।

আলোচনায় ভিয়েতনামি নারিকেল জাত : কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশে গত ২০১৫ সালের পর দেশে ৭ লাখের বেশি অধিক ফলনশীল ভিয়েতনামি জাতের নারিকেলের চারা আমদানি করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এই চারা মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হয়। যদিও ভিয়েতনামি এই নারিকেলের জাত নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই চারা আশানুরূপ ফল দেয়নি। কোনো রকম গবেষণা ছাড়াই ভিয়েতনামি নারিকেলের চারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। অন্যদিকে, প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিক ফলনশীল এই জাতের নারিকেল গাছে আলাদাভাবে সার, পানি প্রয়োগ ও যত্ন নিতে হয়। যারা ঠিকভাবে যত্ন নিয়েছেন তাদের ভালো ফলন হয়েছে। মাঝখানে আমদানি বন্ধ থাকার পর গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ফের ৫ লাখ ভিয়েতনামি খাটো জাতের নারিকেলের চারা আমদানির অনুমোদন দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। বেসরকারি কোম্পানি মল্লিকা সিড এই চারা আমদানি ও মার্কেটিংয়ের অনুমোদন পায়। তবে, শুধুই উপকূলীয় অঞ্চলে এই চারা মার্কেটিং করার সুযোগ দেয়া হয়। তবে, মল্লিকা সিডের স্বত্বাধিকারী এফ আর মালিক গত মঙ্গলবার নয়া দিগন্তকে বলেন, অনুমোদন দেয়ার পর ২৮ হাজার চারা দেশে আসে। এ বছরের শুরু থেকে আর কোনো আইপি (আমদানি অনুমতি) দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, আমরা চারা আনি না এরপরও ইউটিউভ খুললেই দেখি ভিয়েতনামি চারার বিজ্ঞাপন। এখন একটা পক্ষ যে এই জাত নিয়ে নানা কথা বলে এর কারণ হতে পারে খাঁটি ভিয়েতনামি জাত অনেকে না পেয়ে ভিন্ন জাতের নারিকেল লাগাচ্ছেন। এ কারণে ফল আসছে না। আবার ফল কম হওয়ার আরেক কারণ, ভিয়েতনামি জাতের নারিকেলে যত্ন নিতে হয়। ঠিক মতো সার দিতে হয়, পানি দিতে হয়। কৃষকরা এই কাজটি ঠিকমতো করেন না।

কেন কমছে উৎপাদন, বাড়ছে ডাবের দাম?
কেন কমছে নারিকেল বা ডাবের উৎপাদন এর সঠিক কারণ বলতে পারেননি ডিএইর হর্টিকালচার উইংয়ের পরিচালক মো: নোয়াখেরুল ইসলাম। মাস দুয়েক আগে এই উইংয়ে যোগদান করা এই কৃষিবিদ বলেন, ডাব বা নারিকেল গাছে এক ধরনের ছত্রাক রোগ দেখা যাচ্ছে। রোগে পাতাগুলো মরে যায়। ফলনও কম হয়। এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ ও ২০২১ সালে দেশে করোনা মহামারীর সময় ডাবের ব্যাপক চাহিদা ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে আবার ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা অনেক বেড়েছে। তাই কৃষকেরা ডাবে ভালো দাম পাওয়ায় নারিকেল হওয়ার আগেই গত কয়েক বছর ধরে বিক্রি করে দিচ্ছেন। দেশের বেসরকারি বীজ সেক্টরের অন্যতম দিকপাল এফ আর মালিক বলেন, ডিমান্ড এবং সাপ্লাই চেইন ঠিক না থাকলে যেকোনো জিনিসেরই দাম বাড়ে। তখন সিন্ডিকেটের সুযোগ হয়। ডাব পেকে ঝুনা হওয়ার পর নারিকেল হয়। নারিকেল থেকে চারা হয়। কিন্তু গত কয়েক বছর ডাবের চাহিদা বেশি হওয়ায় কৃষক গাছ থেকে ডাব বিক্রি করে দিচ্ছেন। নারিকেল যেহেতু হয়নি, চারাও উৎপাদন হয়নি। যে কারণে নতুন করে নারিকেল গাছ হয়নি। এছাড়া, অতিরিক্ত খরায় ডাবে টান পড়েছে। তবে, এ অবস্থায় খাটো জাতের নারিকেল চারা আমদানির অনুমোদন দেয়া উচিত। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. বাবুল চন্দ্র সরকার নয়া দিগন্তকে বলেন, নারিকেল বা ডাব চাষ অধিক শীত অনুকূল নয়। দিন রাতের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকতে হবে। এটা একটা বাংলাদেশে সমস্যা। এজন্য দেখবেন নোয়াখালী, বা বরিশাল এলাকায় নারিকেল ভালো হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ তাপমাত্রা চলছে। গাছে পানি দেয়া দরকার, সার দেয়া দরকার। কিন্তু বেশির ভাগ কৃষকই কিন্তু সেটা ঠিক মতো করে না। উৎপাদন কম হওয়ার পেছনে আরো কিছু কারণ রয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/773781