৩১ আগস্ট ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৮:৪২

জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে গুমের ঘটনা তদন্ত শুরুর আহ্বান এইচআরডব্লিউর

বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে একটি স্বাধীন কমিশনকে সহায়তার জন্য জাতিসংঘের প্রস্তাব সরকারের গ্রহণ করা উচিত। গতকাল বুধবার ‘গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস’ উপলক্ষে এই আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই আহ্বান সংগঠনটির ওয়েবসাইটে গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশ করা হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা দেশটির কর্তৃপক্ষ বারবার অস্বীকার করে আসছে। উল্টো তারা প্রহসনমূলক দাবির পুনরাবৃত্তি করে বলে আসছে, নিখোঁজ ব্যক্তিরা আত্মগোপনে আছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বাংলাদেশি মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের মতে, নিরাপত্তা বাহিনী ২০০৯ সাল থেকে ৬০০-এর বেশি ব্যক্তিকে গুম করেছে। যদিও পরে কিছু লোককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, আদালতে হাজির করা হয়েছিল বা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে গুলিবিনিময়ে মারা গেছেন বলে বলা হয়েছিল। তবে এখনো প্রায় ১০০ ব্যক্তি নিখোঁজ। আন্তর্জাতিক মানদ-ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গুমের অভিযোগ তদন্তে একটি বিশেষ পদ্ধতি গড়ে তুলতে জাতিসংঘের সহায়তার প্রস্তাব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে সরকার। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, গুমের বাস্তবতা ধারাবাহিকভাবে অস্বীকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ শুধু তামাশা করছে না, উল্টো তারা ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কষ্টকে দীর্ঘায়িত করছে। এই পরিবারগুলো তাদের প্রিয়জনের অবস্থান জানতে মরিয়া হয়ে আছে। জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, এই অন্যায়ের সুরাহায় বাংলাদেশ সরকার যে সত্যিই অঙ্গীকারবদ্ধ, তা প্রমাণে গুমের ঘটনা তদন্তে একটি স্বাধীন কমিশন চালুর বিষয়ে তাদের জাতিসংঘের সঙ্গে সহযোগিতা করা উচিত।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উল্লেখ করেছে, আদিবা ইসলামের (১২) বাবা পারভেজ হোসেন। তিনি বিএনপির একজন কর্মী। তিনি ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর গুমের শিকার হন। তখন আদিবার বয়স ছিল ২ বছর। আদিবা সাম্প্রতিক এক প্রতিবাদ সমাবেশে বলে, একদিন তার বাবা তার কাছে ফিরে আসবেন, আর তিনি তাকে অন্যদের মতোই আলিঙ্গন করবেনÍএই আশা নিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে অপেক্ষা করা যে কতটা বেদনাদায়ক, তা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। কিন্তু ১০ বছর হয়ে গেছে, তার অপেক্ষার শেষ নেই। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, পারভেজ ও অন্য তিন বিএনপিকর্মী বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে একটি পার্কে যখন হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখন একটি সাদা রঙের গাড়ি এসে তাঁদের টেনে ভেতরে নিয়ে যায়। চারজনকে তুলে নেওয়ার কিছুক্ষণ পরই এক পরিচিত ব্যক্তি জানান, তিনি তাঁদের গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে সংস্থাটির কার্যালয়ে দেখেছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ পারভেজকে আটক করার খবর অস্বীকার করে। আরও বেশ কিছু মানুষের মতো পারভেজের হদিস অজানা রয়ে গেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, নির্যাতন-নিপীড়ন, বিশেষ করে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং সংস্থাটির শীর্ষ কমান্ডারদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। তা সত্ত্বেও স্বাধীন ও স্বচ্ছভাবে গুমের অভিযোগ তদন্তের পরিবর্তে কর্তৃপক্ষ ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে হয়রানি ও ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বলছে, পুলিশের কাছে নিখোঁজের বিষয়ে অভিযোগ করা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ বারবার স্বজনদের অবস্থানের বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। গুমে নিরাপত্তা বাহিনী জড়িত-এমন প্রমাণ মুছে ফেলতে কর্মকর্তারা এ-সংক্রান্ত অভিযোগ প্রত্যাহার বা সংশোধনে পরিবারগুলোকে হুমকি ও চাপ দিয়ে আসছেন। পরিবারগুলো তাদের বাড়িতে কর্তৃপক্ষের উপস্থিত হওয়ার অভিযোগ করেছে। পরিবারের সদস্যদের গুম করা হয়নি, তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে পুলিশকে বিভ্রান্ত করেছেন-এমন মিথ্যা বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে তাদের বাধ্য করা হয়েছে বলে পরিবারগুলো অভিযোগ করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা ও কর্তৃপক্ষ বারবার কূটনীতিকদের গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে বাধা দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা উল্লেখ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, এই ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের পক্ষে সাফাই গেয়েছে সরকার। তারা পরামর্শ দিয়ে বলেছে, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এমন বৈঠক করা উচিত হয়নি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক গুমের বিষয়টিকে অর্থপূর্ণভাবে খতিয়ে দেখতে দাতাদেশ, জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা ও সুশীল সমাজের আহ্বানকে বারবার উপেক্ষা করে আসছে বাংলাদেশ সরকার। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, গুমসংক্রান্ত সনদ ছাড়া জাতিসংঘের সব মূল মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ বাংলাদেশ। ২০২২ সালের আগস্টে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক তৎকালীন হাইকমিশনার মিশেল ব্যাসেলেট বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। সফরকালে তিনি বাংলাদেশ সরকারকে জাতিসংঘের এই সনদে সই করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিষয়টি সমাধানে তারা যে অঙ্গীকারবদ্ধ, তা প্রমাণে জাতিসংঘের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানাতে বলেছিলেন তিনি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, বাংলাদেশ সরকার যদি তার নিপীড়ক বাহিনীর ওপর থেকে মানবাধিকার-সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে আন্তরিক হয়ে থাকে, তাহলে জবাবদিহির ব্যাপারে তার দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এ কথা স্বীকার করার মাধ্যমে জবাবদিহি শুরু হয় যে-গুমের ঘটনা ঘটছে, আর স্বচ্ছ ও স্বাধীনভাবে এসব অভিযোগের তদন্ত করা হচ্ছে।

https://www.dailysangram.info/post/534180