২৯ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১০:০৮

চালের বাজার বেসামাল

হাওরের বন্যা দুর্গতি বাড়িয়েছে মানুষের

সব ধরনের চালের দাম বছরজুড়েই বাড়তি। বাজারে নতুন চাল আসতে শুরু করেছে। দাম এখন কমতির দিকে থাকার কথা। হাওরের পাহাড়ি ঢল দুর্গতি বাড়িয়েছে সারা দেশের মানুষের। নতুন অজুহাতে নতুন করে দাম বেড়েছে আরেক দফা। ৪০ টাকার কমে মোটা চাল মিলছে না। সরু চালের ভোক্তাদের গুনতে হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা। চালের এই নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতির জন্য খুচরা বিক্রেতারা দুষছেন পাইকারদের। পাইকারি বিক্রেতাদের অভিযোগ মজুতদার মিলমালিকদের প্রতি। আর অর্থনীতিবিদের বিশ্লেষণ, সরকারের দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট ক্রয়নীতিই সামগ্রিক বেসামাল পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
গতকাল শুক্রবার রাজধানী ঢাকার কয়েকটি খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, পারিজা-স্বর্ণার মতো মোটা চালও বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে। আটাশ ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা। নাজিরশাইলের কেজি ৫৬ থেকে ৫৭ টাকা। মিনিকেট ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা। বাসমতি বিক্রি হচ্ছে ৫৯ থেকে ৬২ টাকা দরে। অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় গরিব মানুষদের জন্য সরকারি কর্মসূচি ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির কার্যক্রম এখন বন্ধ। মান যতই নিম্ন হোক ১৫ টাকা কেজি দরে ট্রাকে চাল বিক্রির কার্যক্রমও অভাবী মানুষদের তেমন কাজে আসছে না। কারণ, এ কর্মসূচির ট্রাকসংখ্যা খুবই কম। আমার একটি ট্রাকে মাত্র এক টন চাল সরবরাহ করায় প্রথম ধাক্কাতেই শেষ হয়ে যায় চাল বিক্রি। চালের ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি দেশের সব মানুষকেই নাড়া দিয়েছে। চালের কারণে প্রতিটি পরিবারেই মাসিক খরচ বেড়ে গেছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, গরিব মানুষের জন্য দাম বাড়ানো কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। চালের দাম বাড়ানোর কোনো কারণ এখন নেই। তিনি বলেন, দিন দিন এসব মানুষ নিজের পরিবার চালাতে হাঁপিয়ে উঠছেন। এ বিষয়ে সরকারের নজর দেয়া দরকার। তিনি বলেন, যারা বাজারে অস্বাভাবিক দাম বাড়ায়, তাদের ব্যাপারে সরকার চাইলে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রয়োজনে সরকার বাজার মনিটরিং করতে পারে। তাহলে আসল তথ্য জানা যাবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে; যা আগের বছরের চেয়ে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন বেশি। চলতি অর্থবছরে উৎপাদনের ল্য ৩ কোটি ৫০ লাখ টন। হওরের পরিস্থিতি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেয়া তথ্যানুযায়ী, এবার বোরো মওসুমে ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। এ থেকে ১ কোটি ৯১ লাখ টন চাল উৎপাদনের ল্য ঠিক করেছিল সরকার। তবে হাওর তলিয়ে যাওয়ায় তা কিছুটা কম হওয়ার আশঙ্কা আছে। হাওরের ২ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছিল। সেখান থেকে প্রায় ৯ লাখ টন চাল উৎপাদনের আশা করেছিল অধিদফতর। তবে সেখানকার বড় অংশের ধানই নষ্ট হয়ে যাবে আশঙ্কা তাদের।
যদিও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম দাবি করেছেন হাওর ডুবে গেলেও চালের কোনো ঘাটতি হবে না। তার দাবি, বাংলাদেশে বছরে ১৫ থেকে ২০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকে। হাওরে ছয় লাখ টন কম উৎপাদন হলেও কোনো ঘাটতি হবে না।
১০ বছরে দ্বিগুণ
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ১০ বছরে দেশে চালের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৬ সালে প্রতি কেজি মিনিকেট চালের গড় দাম ছিল ২৭ টাকা ৯৫ পয়সা। ২০১৬ সালে ওই চালের দাম হয় ৪৮ টাকা ৩৪ পয়সা। ২০০৬ সালে নাজিরশাইলের দাম ছিল ২৫ টাকা ৫৪ পয়সা। ২০১৬ সালে ওই চালের দাম হয় ৫৫ টাকা ৭৮ পয়সা। ২০০৬ সালে পাইজাম চালের দাম ছিল ২৩ টাকা। গত বছর ওই চালের দাম ছিল ৪০ টাকা ৩৭ পয়সা। ২০০৬ সালে পারিজা/স্বর্ণার দাম ছিল ১৯ টাকা ২৫ পয়সা। গত বছর ওই চালের দাম ছিল ৩৭ টাকা ১৯ পয়সা। ২০০৬ সালে বিআর এগারো/আটের দাম ছিল ১৮ টাকা ২৫ পয়সা। গত বছর ওই চালের দাম ছিল ৩৫ টাকা ৪১ পয়সা।
সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই এখন মোটা চালের দাম সবচেয়ে বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত থেকে ৫ শতাংশ ভাঙা সেদ্ধ চাল আমদানি করলে এখন দেশের বাজারে প্রতি কেজির সম্ভাব্য মূল্য দাঁড়াবে ৩২ টাকার কিছু বেশি। পাকিস্তান থেকে আনলে তা কেজিপ্রতি প্রায় ৩৫ টাকা পড়বে। অন্য দিকে থাইল্যান্ড থেকে আতপ চাল আমদানি করলে প্রতি কেজি ৩২ টাকা ৪৪ পয়সা ও ভিয়েতনাম থেকে আনলে পড়বে ৩৩ টাকা ৬৪ পয়সা। অথচ দেশে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে।
আমদানি কমেছে অর্ধেক
চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে আমদানি কমে যাওয়ার কথা বলছেন বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে চালের আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কহার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার পর আমদানি কমে যায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে প্রায় দুই লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল প্রায় সাড়ে তিন লাখ টন।
ক্রয়নীতির দুর্বলতা
অনুসন্ধানে জানা যায়, চালের বাজারে অস্থিতিশীলতার জন্য সরকারের ক্রয়নীতিও অনেকাংশে দায়ী। সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যস্বত্বভোগী বানাতে বেশি দামে ধান-চাল কিনছে। এর ফলে কৃষক লাভবান না হলেও দলীয় লোকেরা উপকৃত হচ্ছেন। আর বাজার অস্থিতিশীল হয়ে তার দায় চাপছে দেশের সব মানুষের ঘাড়ে।
গত বছর ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় ২৩ টাকা দরে ধান এবং ৩২ টাকা দরে চাল ক্রয় করে সরকার। কিন্তু ক্রয়নীতিতে দুর্বলতা এবং দলীয় লোকদের মধ্যস্বত্ব ভোগের কারণে কৃষক এ দাম পাননি। সরকার ৯২০ টাকা দর বেঁধে দিলেও মওসুমের শুরুতে কৃষক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। আর এই সুযোগটা নিয়ে ধান মজুত করেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, চলতি মওসুমে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে ২২। চালে খরচ পড়ছে ৩১ টাকা। চলতি মওসুমের জন্য ধান ও চালের সরকারি ক্রয়মূল্য ইতোমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। এবার ৭ লাখ টন ধান কিনবে সরকার। চাল কেনা হবে ৮ লাখ টন। প্রতি কেজি ধানের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪ টাকা। চালের দাম ৩৪ টাকা। এর ফলে নতুন করে চালের বাজার অস্থিতিশীল হচ্ছে বলে জানান বিশ্লেষকেরা।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/216072