১৯ আগস্ট ২০২৩, শনিবার, ৮:১০

রাসেলস ভাইপারে মৃত্যুহার দ্বিগুণ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে আক্রান্ত বেশি

দেশের প্রায় ২০টি জেলায় ১৪ বছর ধরে ছড়িয়ে পড়া ভয়ংকর সাপ রাসেলস ভাইপার (চন্দ্রবোড়া সাপ) বড় আতঙ্ক হিসাবে দেখা দিয়েছে। অন্যসব বিষধর সাপ সাধারণত এক বা দুই ধরনের বিষক্রিয়া ছড়ালেও রাসেল ভাইপারের বিষ একাধারে হেমোটক্সিক, রেনোটক্সিক, মাইওটক্সিক ও নিউরোটক্সিক। এর বিষ একসঙ্গে রক্ত, কিডনি, মাংসপেশি, টিস্যু ও স্নায়ুতন্ত্রে বহুবিধ সমস্যা সৃষ্টি করে। এ কারণে এ সাপের কামড়ে আক্রান্তদের চিকিৎসা নিয়ে চিকিৎসকরা চ্যালেঞ্জের মুখে।

গোখরা বা কালাচ সাপের ক্ষেত্রে ভারতীয় প্রতিষেধক (এন্টিভেনম) প্রয়োগের পর আক্রান্তদের ১০-১৫ ভাগ মারা যায়। আর রাসেল ভাইপারের ক্ষেত্রে মারা যাওয়ার হার প্রায় দ্বিগুণ, ৩০ ভাগ। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় রাসেলস ভাইপারের আরও কার্যকরী চিকিৎসার জন্য দেশি রাসেলস ভাইপারের ‘এন্টিবডি’ তৈরির চেষ্টা চলছে। বছর খানেক পর ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।

দেশের উত্তরাঞ্চলে রাসেলস ভাইপারে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ৬ বছরের পরিসংখ্যানে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে আহত ২১ জন ভর্তি হন। তাদের মধ্যে আটজন মারা যান। ২০১৯ সালে ২৮ জনের মধ্যে আটজন মারা যান। ২০২০ সালে ৩৫ জনের মধ্যে ১৩ জন মারা যান। ২০২১ সালে ৩৭ জনের মধ্যে ১০ জন মারা যান। ২০২২ সালে ৩১ জনের মধ্যে ১০ জন মারা গেছেন।

২০২৩ সালে এখন পর্যন্ত ১৪ জনের মধ্যে পাঁচজন মারা গেছেন। এ হিসাবে মৃত্যুহার প্রায় ৩০ শতাংশ। যা অন্যসব বিষধর সাপের কামড়ে মৃত্যুহারের তুলনায় দ্বিগুণ। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর রোগী সবচেয়ে বেশি। এরপরে রয়েছে নওগাঁ, পাবনা ও কুষ্টিয়ার রোগী।

জানা গেছে, রাসেল ভাইপারের কামড়ে আহতদের চিকিৎসায় দক্ষ চিকিৎসক রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক চিকিৎসক ড. আবু শাহীন। বর্তমানে নওগাঁ মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবু শাহীন যুগান্তরকে জানান, এন্টিভেনম দেওয়ার পরও রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ে আক্রান্ত প্রায় ৩০ ভাগ মানুষ মারা যাচ্ছেন। গোখরা বা কালাচের ক্ষেত্রে মৃত্যুহার ১০-১৫ ভাগ। রাসেলস ভাইপার নতুন নতুন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। এর উত্তর আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।

রাসেলস ভাইপারের কামড়ে মৃত্যু কেন বেশি-জানতে চাইলে ড. আবু শাহীন বলেন, এর বিষ মানুষের শরীরের রক্ত, কিডনি, মাংসপেশি, স্নায়ুতন্ত্রে একাধারে সমস্যা করে। বেশি মৃত্যুর প্রধান কারণ দেরি করে হাসপাতালে ভর্তি এবং দেরি করে এন্টিভেনম দেওয়া। দেখা যায়-সাপ কামড়েছে সকালে, অথচ দেরি করে হাসপাতালে আনা হয়েছে; এন্টিভেনম দিতে বিকাল হয়ে গেছে। ততক্ষণে বিষ কিডনির ক্ষতি করে ফেলেছে। এ কারণে এন্টিভেনম দেওয়ার পরও মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। রক্তের বিষ নির্বিষ (নিউট্রালাইজ) করতে পারলেও টিস্যুর বিষ নির্বিষ করতে পারি না। তখন ডায়ালিসিসে যেতে হয়।

ড. আবু শাহীন বলেন, রাসেলস ভাইপারসহ বিষধর সাপে কামড়ের পর শরীরে উপসর্গ দেখা দেওয়ামাত্র দ্রুততম সময়ের মধ্যে এন্টিভেনম দিতে হবে। তাড়াতাড়ি এন্টিভেনম দিলে জটিলতা কম হয় এবং মৃত্যুর সম্ভাবনাও কমে আসে।

রাসেলস ভাইপারের ক্ষেত্রে ভারতীয় এন্টিভেনমের কার্যকারিতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ড. আবু শাহীন বলেন, এন্টিভেনমের কার্যকারিতা বস্তুগতভাবে আমরা পরীক্ষা করতে পারিনি। তবে ক্লিনিক্যালি মনে হয়েছে-এন্টিভেনম দেওয়ার পরও ৬০ ভাগ রোগীর কিডনিতে ইনজুরি দেখা দেয়। অনেক রোগীর ডায়ালিসিস করার প্রয়োজন হয়, অনেকে আবার মারাও যান। এক্ষেত্রে এ এন্টিভেনম কতটা কাজ করছে? প্রশ্ন এসেই যাচ্ছে। এ বিষয়েও গবেষণা দরকার।

এদিকে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টারে দেশীয় রাসেলস ভাইপারের বিষ থেকে ‘এন্টিবডি’ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ভেনম রিসার্চ সেন্টারের সমন্বয়ক ডা. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ যুগান্তরকে বলেন, ল্যাবরেটরিতে এন্টিবডি তৈরি করে দেখাতে চাচ্ছি, আমাদের দেশের রাসেলস ভাইপারের বিপরীতে তৈরি ‘এন্টিবডি’ কতটা বেশি কার্যকর? আমরা যে এন্টিভেনম ব্যবহার করছি তা ভারত থেকে আসা এবং ভারতের সাপের বিপরীতে তৈরি। তিনি জানান, জার্মান হারপেটোলজিস্ট উলরিচ কুচ পরীক্ষা করে দেখেছেন-ভারতের রাসেলস ভাইপার এবং বাংলাদেশের রাসেলস ভাইপারের মধ্যে অনেক পার্থক্য। এ দেশের রাসেল ভাইপারের বিপরীতে এন্টিভেনম তৈরি করা গেলে তা অনেক বেশি কার্যকর হবে।

রাসেলস ভাইপারের ‘এন্টিবডি’ তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. সাঈদ বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে গবেষণার জন্য প্রটোকল আহ্বান করা হলে আমরা রাসেল ভাইপারের বিষয়টি জানাই। বর্তমানে রাসেলস ভাইপারের এন্টিভেনম নয় ‘এন্টিবডি’ নিয়ে কাজ করছি আমরা। এন্টিভেনম তৈরির প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। প্রথমে ঘোড়ার শরীরে সাপের বিষ প্রয়োগ করা হয়। ঘোড়ার শরীরে এন্টিবডি তৈরি হলে তা আলাদা করে ও পরিশোধিত করে এন্টিভেনম (ভ্যাকসিন) তৈরি করা হয়।

একই নিয়মে ছোট পরিসরে আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ল্যাবে রাসেলস ভাইপারের বিষ নির্দিষ্ট পরিমাণে মুরগির শরীরে প্রয়োগ করেছি। এতে এন্টিজেনিক রিঅ্যাকশন হবে, যাতে মুরগির শরীর অল্প অল্প করে এন্টিবডি তৈরি করতে পারে। একইভাবে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এন্টিভেনম দিয়ে তার বিপরীতে এন্টিবডি তৈরি করা হবে। যখন মুরগি ডিম পাড়বে তখন ডিমের কুসুম বাদ দিয়ে সাদা অংশ থেকে রাসেলস ভাইপারের এন্টিবডি পৃথক করা হবে।

পরবর্তী সময়ে সেই এন্টিবডি ইঁদুরের শরীরে দেওয়া হবে। দেওয়া হবে রাসেলস ভাইপারের বিষও। দেখা হবে-বিষ এ এন্টিবডি ধ্বংস করতে পারে কিনা। তখন বলা যাবে ল্যাবরেটরিতে আমরা একটা ‘এন্টিবডি’ তৈরি করতে পেরেছি। আগামী এক বছরের মধ্যে আমরা এ পরীক্ষার ফলাফল জানাতে পারব বলে আশা করছি।

দেশে রাসেলস ভাইপারের বিস্তৃতি নিয়ে রাজশাহীর সাপ বিশেষজ্ঞ বোরহান বিশ্বাস রোমন গবেষণা করছেন। যুগান্তরকে তিনি বলেন, একটি কথা বলা হয়-রাসেলস ভাইপার বাংলাদেশে বিলুপ্ত ছিল। এটি সঠিক মনে করি না। দেশে আসলে রাসেলস ভাইপার টিকে ছিল। কেউ বিষয়টি সার্ভে করেনি। আর নতুন করে এসেছে নদীপথে। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে রাসেলস ভাইপার পুনরায় প্রথম পাওয়া যায়।

২০১০ সালে চাঁপাইনবাগঞ্জে যেখানে পদ্মা নদীর শুরু সেখানে, ২০১১ সালে রাজশাহী শহরের কাছাকাছি (৫০-৬০ কিলোমিটারের ভেতরে) এবং ২০১২ সালে রাজশাহী ও নাটোরের মাঝামাঝি গোপালপুর-লালপুরে রাসেলস ভাইপার পাওয়া যায়। ২০১৩ সালে ঈশ্বরদীর রূপপুরে, ২০১৪ সালে গড়াই নদী এবং ২০১৫ সালে চরভদ্রাসনে পাওয়া যায়। চাঁদপুর পর্যন্ত এ সাপ ছড়িয়ে গেছে। যেতে যেতে কেমন বংশবৃদ্ধি করছে তা জানা দরকার।

বোরহান বিশ্বাস রোমন বলেন, নদী অববাহিকা, চরাঞ্চল এবং বরেন্দ্র অঞ্চলে রাসেলস ভাইপারের মূল বসবাস। তাই এসব জায়গায় সচেতনতা বাড়াতে হবে। কৃষি জমিতে কাজের সময় গামবুট ব্যবহার করতে হবে। ধান কাটার সময় যান্ত্রিক সুবিধা নিতে হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/708310