ফেনী নদীর ভাটি এলাকায় পলি জমায় মুহুরী সেচ প্রকল্প কার্যকারিতা হারাচ্ছে। এতে চট্টগ্রাম ও ফেনী সীমান্তবর্তী এই নদীর স্বাভাবিক গতি বদলে যাচ্ছে। শুরু হয়ে গেছে নদীভাঙন। সিডিএসপি বাঁধের কাছাকাছি চলে এসেছে এই ভাঙন।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ভেঙে গেলে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেবে। পাশের এলাকার মানুষ হারাবে ভিটাবাড়ি, কৃষক হারাবেন জমি, নদীগর্ভে বিলীন হবে শত শত মত্স্যঘের। এই এলাকায় বাস্তবায়িত হতে যাওয়া দেশের সর্ববৃহৎ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের উন্নয়নকাজও ঝুঁকিতে পড়বে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্পের ভাটিতে প্রায় ৭০০ বর্গমিটার এলাকায় পলির স্তর জমেছে।
এতে নদীর প্রবাহপথ বদলে একদিকে ছোট ছোট চর জেগেছে, অন্যদিকে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পলি জমার কারণে সেচ প্রকল্পের বেশ কিছু জলকপাট (স্লুইস গেট) কাজে আসছে না।
মিরসরাইয়ের ওচমানপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা দুখু মিয়া কালের কণ্ঠকে জানান, ২০১৯ সালের শুকনো মৌসুমে প্রকল্পের মুখে বালু ও মাটি জমা শুরু হয়। ওই বছরের বর্ষায় ভাঙন শুরু হয়।
এর আগে প্রায় ৩৫ বছরে এমন ভাঙন দেখা যায়নি। এরই মধ্যে শতাধিক মত্স্যঘের নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
এদিকে প্রতিবছর শুকনো মৌসুমে মুহুরী সেচ প্রকল্পের আওতায় মিরসরাই, ফেনী ও সোনাগাজী উপজেলার ২৭.১২৫ হেক্টর জমি ধান চাষের আওতায় আসে। স্থানীয়দের আশঙ্কা, পলি এলাকা জরুরি ভিত্তিতে ড্রেজিং করা না হলে উজানে গ্রামের পর গ্রাম বন্যাকবলিত হতে পারে। জমিগুলোও অনাবাদি পড়ে থাকতে পারে।
মিরসরাইয়ের ওচমানপুর ইউনিয়নের আজমপুর গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘আমরা নদীর আচরণ বুঝি। পলিমাটি খনন করলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। গত ৩৫ বছর এখানে আমরা ভাঙন দেখিনি। এখন পলি জমার কারণে ভাঙন হচ্ছে।’
সিডিএসপি বাঁধ ভাঙলে বিপর্যয়
মিরসরাইয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা বঙ্গোপসাগরের ভাঙন থেকে রক্ষা করতে ১৯৯৪ সালে চর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সেটলমেন্ট প্রজেক্টের (সিডিএসপি) আওতায় ১১.৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এতে বাঁশখালী ও ইছাখালী এলাকায় গড়ে ওঠে হাজার হাজার একর মত্স্যঘের। এখান থেকে চট্টগ্রামের মাছের চাহিদার ৭০ শতাংশ উৎপাদিত হয়।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের আগস্ট মাসে সিডিএসপি বাঁধের কিছু অংশ ভেঙে সাগরে বিলীন হয়। তখন ভাঙা অংশে নদীর প্রবাহ অন্য দিক দিয়ে ঘুরিয়ে বাঁধ নতুন করে নির্মাণ করা হয়।
সিডিএসপি বাঁধ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাঁধের উত্তর অংশের প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা ফেনী নদীর অববাহিকায় পড়েছে। বাকি অংশ বঙ্গোপসাগর অববাহিকায়। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একসময় নদী ও সাগর থেকে বাঁধের দূরত্ব ছিল প্রায় ৭০০ মিটার। বর্তমানে এই দূরত্ব কোথাও ১০ মিটার, কোথাও ১৫ মিটার। স্থানীয়রা জানায়, বিভিন্ন সময় ভাঙন রোধে পাউবো থেকে সিসি ব্লক দেওয়া হলেও সেগুলো নদীগর্ভে চলে গেছে। অবশ্য এখন সিডিএসপি বাঁধের পশ্চিম পাশে সুরক্ষা ব্লক না বসালে চলতি বর্ষায় বাঁধ ভেঙে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
মিরসরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি সরেজমিনে গিয়ে দেখেছি। সেখানে ভয়ংকর অবস্থা। যেকোনো সময় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিতে ২০২১ সালে আমরা পানিসম্পদমন্ত্রী ও সচিব বরাবর ই-মেইলে চিঠি দিয়েছিলাম। এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘ভাঙনের বিষয়ে আমি অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা বলেছি। তারা এ ধরনের প্রকল্পে অর্থায়ন করতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। পরে পাউবোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এখনো কিছু হয়নি।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহফুজা জেরিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাউবো কর্তৃপক্ষ দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেবে। এখানকার জনবসতি, মত্স্য প্রকল্প ও বাস্তবায়নাধীন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নকাজ ক্ষতির মুখে পড়বে। আমি বিষয়টি দেখছি এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে কথা বলব।’
এ বিষয়ে ফেনী পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আরিফুর রহমান চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নদীর ভাটি এলাকায় জমে থাকা পলি ড্রেজিংয়ের জন্য আমরা আরো আগে উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এ বিষয়ে ২০২১ সালে একটি টেকনিক্যাল কমিটিও করা হয়েছিল। তখন অন্যজন দায়িত্বে ছিলেন। এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি নেই।’
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত উদ্যোগ নেব।’
ফেনী, মুহুরী ও কালিদাস নদীর সম্মিলিত পানিপ্রবাহকে সেচকাজে লাগাতে এবং ফেনী, সোনাগাজী ও মিরসরাই এলাকাকে বন্যা ও ভাঙনের হাত থেকে রক্ষায় মুহুরী সেচ প্রকল্প করা হয়। ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে শুরু হয়ে ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়।