১৭ আগস্ট ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৭:০৫

অর্থায়ন সমস্যা, সংকটে অনেক এনজিও

স্বাধীনতার পর থেকে আর্থসামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা ছিল বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর। এখনো খাতওয়ারি বিভিন্ন সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এসব সংস্থায় অর্থায়ন করে থাকে মূলত বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু সংস্থা অর্থায়ন সংকটে ভুগছে। এ অবস্থায় কোনো কোনো এনজিও নিজেদের কার্যক্রম গোটানোরও চিন্তা করছে। বিশেষ করে নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বেশি সংকটে রয়েছে। এসব সংস্থার সংশ্লিষ্টদের দাবি, অনেক ক্ষেত্রে অর্থায়ন কমে গেছে। যেসব অর্থায়ন আসছে তাও আবার এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর ছাড়পত্র সহজে মিলছে না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোও অর্থায়ন সংকটে ভুগছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন সংস্থা সংশ্লিষ্টরা।

তারা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর ধরে সংস্থাগুলোয় বিদেশ থেকে তহবিল আসা অনেকটা কমেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় এখন আর তহবিলের জোগান দিতে চাইছে না বিদেশি দাতারা।

এ ছাড়া কোভিডকালীন বিপত্তি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির চলমান দুঃসময়ও এখানে বড় একটি ভূমিকা রেখেছে। একইসঙ্গে এনজিও বিষয়ক ব্যুরো থেকে তহবিল ছাড়পত্র নিয়েও জটিলতার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বিদেশি তহবিল আসা ভয়াবহ আকারে কমেছে। এর মধ্যেই বিদেশি অনুদানের অর্থ ছাড়ে অনেক সময়ক্ষেপণ করছে এনজিও বিষয়ক ব্যুরো। এমনকি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও অর্থ ছাড় দেয়া হয় না কোনো কোনো ক্ষেত্রে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি বেশি হচ্ছে। অর্থ ছাড় না পেয়ে অনেক এনজিও’র কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছে বলেও জানান তারা।

নির্বাচন ও সুশাসন নিয়ে কাজ করে এমন একটি এনজিও’র নির্বাহী কমিটির সদস্য মানবজমিনকে বলেন, বিদেশ থেকে তহবিল আসা কমে যাওয়ায় দেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলো আর্থিক সংকটে রয়েছে। আর এসব এনজিও’র অর্থ ছাড়ে সরকার থেকে অনেক কড়াকড়ি করা হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশি অনুদানে চলমান কর্মসূচি ও প্রকল্পগুলোর অনুমোদনেও সময়ক্ষেপণ করছে এনজিও বিষয়ক ব্যুরো। প্রকল্পগুলোর অর্থ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। এজন্য এনজিওগুলো তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। তিনি বলেন, ৬ থেকে ৭ মাস ধরে সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছে। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারাবাহিকতা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির চলমান দুঃসময়ে যখন বিদেশি দাতারা তহবিলের জোগান দিতে চাইছে না তখন এনজিও বিষয়ক ব্যুরো থেকে অসহযোগিতা পেলে এনজিওগুলো তাদের কার্যক্রম চালাতে পারবে না।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, দেশে ৩০ বছর আগে এনজিও ব্যুরো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ওয়ান স্টপ সার্ভিসের জন্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি থেকে এখন ওয়ান স্টপ সার্ভিস পাওয়া যায় না। এনজিও ব্যুরো বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো থেকে আসা অর্থ ছাড় দিতে অনেক সময় নিয়ে থাকে। এতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। তিনি বলেন, আমার অনেক জানতে ইচ্ছে করে যে দ্রুত অর্থ ছাড়ের বাধাগুলো আসলে কোথায়? এখানে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ থাকে না, এজন্য সমস্যাটি থেকেই যায়। তিনি আরও বলেন, সকল ধরনের এনজিও’র ক্ষেত্রেই অর্থ ছাড়ের সমস্যা একইভাবে প্রযোজ্য। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট কিছু অর্থ ছাড় পেয়েছে জানিয়ে ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

এদিকে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি এনজিও’র প্রধান নির্বাহী বলেন, এনজিও বিষয়ক ব্যুরো থেকে বিদেশি অনুদানের অর্থ ছাড় পাওয়া অনেক জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থ ছাড় দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর। অনেক সময় প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও অর্থ ছাড় দেয়া হয় না। এমন পরিস্থিতিতে অর্থ সংকটে পড়ে অনেক এনজিও তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিচ্ছে বলে আমার কাছে খবর আছে। তিনি বলেন, বৈদেশিক অনুদানে চলা অধিকাংশ এনজিও এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। তবে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলোর ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি বেশি হচ্ছে।

নিজেরা করি’র সেক্রেটারি ও মানবাধিকার নেত্রী খুশি কবির বলেন, দাতারা ৯০-এর দশকে সার্বিক উন্নয়নের জন্য যেভাবে অনুদান দিতেন এখন সেটি দিচ্ছে না। এখন তারা বিশেষ কিছু সেক্টরে অনুদান দিচ্ছে। দাতারা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে ইনভেস্ট করতে চাচ্ছে বেশি। তিনি বলেন, এনজিও বিষয়ক ব্যুরো থেকে অর্থ ছাড়ে দেরি হওয়ার কথা আমাকে অনেকেই বলেছেন। অনেক সময় ইউএনও এবং ডিসির ছাড়পত্র পেতেও সমস্যা হয়।

মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা একটি এনজিও সূত্র জানিয়েছে, অর্থায়ন সংকটে দীর্ঘদিন তাদের সেবা বিঘ্নিত হয়। বছর দুয়েক ধরে সংস্থাটি নিজস্ব অর্থায়নে চলা শুরু করেছে। এজন্য সাধারণ মানুষকে সেবা মূল্য বেশি দিতে হচ্ছে। সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা জানান, বিদেশি সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম এখনো চলছে। তবে নিজস্ব আয়ে সবকিছু চালাতে হচ্ছে। এজন্য প্রতিটি সেবার মূল্য বাড়াতে হয়েছে। আমরা অনেকটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মতো হয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, দেশ এখন মধ্যম আয়ের পর্যায়ে এসেছে। এই প্রচারণা সরকারিভাবেই হচ্ছে। এ কারণে বড় দাতারা অনুদানে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

অর্থ ছাড়ে কড়াকড়ির অভিযোগ অস্বীকার করে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক শেখ মো. মনিরুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, সবকিছুই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলছে। অর্থ ছাড়ে কোনো দেরি করা হচ্ছে না। বৈদেশিক সাহায্য আসলে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। এনজিওগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কিছু এনজিও ব্যুরো করছে না।

https://mzamin.com/news.php?news=69686