২৯ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ৮:৪৭

মহামারীর মতই চোখের পলকে বোরো ধান গাছ লাল হয়ে মরে যাচ্ছে

কৃষকরা আতঙ্কিত : রংপুর কৃষি অঞ্চলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল

দিনাজপুর থেকে মাহফুজুল হক আনার : ১৫ থেকে ২০ দিনের মাথায় ধান কেটে ঘরে তোলার স্বপ্ন দেখছিল কৃষকরা। বছরের প্রধান অর্থকরী ফসল বোরো ধানকে ঘিরে মেয়ের বিয়ে থেকে সন্তানের খৎনাসহ আরো কতনা স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা করে থাকে কৃষকরা। কিন্তু সব স্বপ্ন যেন নিমিষেই হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে দিনাজপুরসহ আশপাশ এলাকার কৃষকদের। স্বপ্নের জায়গায় দেখা দিয়েছে আতঙ্ক, চোখের পলকে এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে বোরো ধানের গাছ লাল হয়ে যাচ্ছে। পাক ধরা ধানের শীষ হেলে পড়ছে, যে সকল শীষে দানা আসেনি তা চিটা হয়ে যাচ্ছে। জেলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে খবর আসতে থাকে ধানের গাছ লাল হয়ে যাওয়ার। বিষ বা কোন কিছু দিয়েই রক্ষা করা যাচ্ছে না। লাল হওয়ার পর পরই সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। যেন মহামারী। চোখের সামনে এভাবে ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কৃষকেরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কৃষি বিভাগও যেন অসহায়। জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা গা বাঁচানোর জন্য বিষয়টিকে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তা ও কর্মীরা বিষয়টিকে গুরুতর বলছে। একদিকে চালের উচ্চ মুল্য অপরদিকে বোরো ধানের বেহাল দশা। কি খাবে আর কি করবে কৃষকেরা। অসহায় কৃষকেরা এখন সরকারের সহানুভূতি কামনা করছে। এ অবস্থা পুরো রংপুর অঞ্চলে। এ কারণে রংপুর কৃষি অঞ্চলের কৃষি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা গেছে।
দিনাজপুরের বিরল উপজেলা’র বহলা গ্রাম। যেদিকে চোখ যাবে শুধু ধানের ক্ষেত। এই এলাকার কৃষকদের মুখ হাসিতে ভরা ছিল। মজুরকে অগ্রিম টাকা দিয়ে ধান কাটার প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু গত ৫ দিনে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। খরতাপের মাস চৈত্রে অকাল বৃষ্টি আর কাল বৈশাখী’র পর প্রখর রৌদ্রতাপ। এই এলাকার কৃষক শ্রী অমল চন্দ্র রায় জানান, হঠাৎ করেই ধান লাল হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে গাছের পাতাগুলা জ্বলে যাচ্ছে। শ্রী মান নামে আরেক কৃষক বললেন ৬ বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছি। ভালই ছিল কিন্তু হঠাৎ কি হলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই ধান লাল হয়ে চিটা হয়ে গেল। এই উপজেলার দক্ষিণ জগতপুর, চেতরা, নাড়াবাড়ী, তেঁতুলতলা, বানিয়াপাড়াসহ আরো অনেক এলাকায় ধান লাল হয়ে গাছ মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে এর পরিমাণ। কৃষি কর্মকর্তারা বলছে এটি নেক বøাষ্ট রোগ। কিন্তু কৃষকেরা বলছে নেক বøাষ্ট রোগ নয় কারন এই রোগে আক্রান্ত ধান সাদা হয়ে চিটা হয়ে যায়। কিন্তু এই অঞ্চলে পাক ধরা ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হেলে পড়ছে শীষ। গাছ মরে যাচ্ছে।
সদর উপজেলার দক্ষিণ কোতয়ালী মহব্বতপুর গ্রামের কৃষক আশরাফ ও সামিউল জানালেন, আমরা কি করবো। পোকা হলে বিষ দিয়ে মারা যায়। কিন্তু চোখের সামনে গাছ লাল হয়ে যাওয়া রোগ দেখে কিছুই করার থাকছে না। আমরা শুধু অপেক্ষা করছি পাশের জমির ধান যেন লাল হয়ে নষ্ট না হয়। তাদের মতে ঘন্টায় ঘন্টায় ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ বাড়ছে। সবকিছু হারাবার আশঙ্কায় কৃষকরা জমির কাছে দাঁড়িয়ে থাকছে। প্রতিকারের ব্যাপারে কৃষি বিভাগ কোন সু-পরামর্শ দিচ্ছে না বলে কৃষকরা অভিযোগ করছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ গোলাম মোস্তফাকে তার দপ্তরে না পেয়ে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না। তিনি জানান জেলার ১ লক্ষ ৭৭ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে মাত্র বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৫ দশমিক ৬ হেক্টর জমি বøাষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের চিত্র ভিন্ন। আউলিয়াপুর ইউনিয়নের সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মনিরুল স্পষ্টভাবেই বললেন এই রোগের অন্যতম কারন হচ্ছে অতি বৃষ্টি। বৃষ্টির পানিতে থাকা নাইট্রোজেন আর সারের নাইট্রোজেন হঠাৎ রৌদ্রতাপ সহ্য করতে না পারায় গাছ লাল হয়ে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে ধান।
কৃষি নির্ভর দিনাজপুর অঞ্চলের হাজার হাজার হেক্টর জমি’র ধার মরে গেছে এবং প্রতিনিয়ত এটা বাড়ছে তা মাঠ পর্যায়ের চিত্রই বলে দিচ্ছে। নিজেদের গা বাঁচিয়ে মাঠ পর্যায়ের প্রকৃত চিত্র সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরে আগে-ভাগেই প্রস্তুতি গ্রহণ জরুরী হয়ে পড়েছে। কেননা কৃষকের ঘরে যদি বোরো ধান না উঠে তাহলে হাহাকার অবস্থার সৃষ্টি হবে। যা সামাল দিতে সরকারকে বড় কোন ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/77338/