৫ আগস্ট ২০২৩, শনিবার, ১:৪৬

সঙ্কটে বরেন্দ্র অঞ্চল

বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছরই অস্বাভাবিক হারে নিচে নামছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনাবৃষ্টি সেই সাথে অনিয়ন্ত্রিত পানি উত্তোলনে পানিশূন্যতার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এ অঞ্চলের ৪০ ভাগ ইউনিয়নে। এতে সেচ ও খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সাধারণ টিউবওয়েলে পানি মিলছে না। গভীর পাম্প বসিয়ে খাবার পানি তুলতে হচ্ছে। অনেক স্থানে তাতেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বলা যায় দ্রুত মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চল। অনাবৃষ্টির ফলে খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর শুকিয়ে গেছে। এতে কৃষিতেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কম বৃষ্টিপাত, বেশি খরা ও ভূগর্ভের পানি নিচে নামছে। গেল জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে রাজশাহীর তানোরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে ১১৩ ফুটের মতো। ১৯৯০ সালে সেখানে পানির স্তর ছিল ৬৮ ফুট নিচে। তবে গত দশ বছরে পানির স্তর দ্রুত নিচে নামছে। ২০১০ সালে যেখানে পানির স্তর ছিল ৫০ ফুট নিচে সেখানে ২০২১ সালে পানির স্তর ৬০ ফুট নিচে নেমেছে। অর্থাৎ প্রতি বছরই পানির স্তর ১ ফুট করে নিচে নামছে। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে গত বছর পানির স্তর ২ ফুট নিচে নেমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই মরুকরণ রোধে দ্রুত যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ না করলে বরেন্দ্র অঞ্চল এক ভয়াবহ দুর্যোগের কবলে পড়বে। মরুকরণ রোধ করতে ওই অঞ্চলে নতুন পুকুর খনন ও বিদ্যমান পুকুরগুলোর পুনঃখনন, কম পানি লাগে এমন ফসলের চাষ এবং ভূগর্ভস্থ পানির কৃত্রিম রিচার্জে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে কম বৃষ্টিপাত, খরা এবং আতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। চলতি বছরের বর্ষাকালে অর্থাৎ জুলাই ও আগস্টে গত চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। একই সঙ্গে এই দুমাসের মধ্যে অন্তত পনের দিন দেশের কোনো না কোনো জায়গায় দাবদাহের মতো পরিস্থিতি দেখা গেছে, যা অনেকটাই নজিরবিহীন। দেশে সাধারণত জুলাই মাসে গড়ে প্রায় ৫শ’ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও এ বছর হয়েছে মাত্র ২১১ মিলিমিটার।

পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ইনকিলাবকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সারা বিশ্বেই এখন প্রকট হচ্ছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব দৃশ্যমান। এবার জুলাই মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৭ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে যা গত ৪৬ বছরের মধ্যে আর হয়নি। কমবৃষ্টিপাত এবং মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া তরান্বিত হচ্ছে। এর থেকে উত্তোরণের জন্য নতুন পুকুর খনন ও বিদ্যমান পুকুরগুলোর পুনঃখনন, কম পানি লাগে এমন ফসলের চাষ এবং ভূগর্ভস্থ পানির কৃত্রিম রিচার্জে জোর দিতে হবে। এসব কথা অনেক দিন থেকে বলে আসছি। কিন্তু তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ফলে বরেন্দ্র অঞ্চল ভয়াবহ দুর্যোগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানি পরিস্থিতি নিয়ে হাইড্রোলজিক্যাল অনুসন্ধান ও মডেলিং শীর্ষক গবেষণা করেছে। গবেষণাটি ২০১৮ সালে শুরু হয় এবং চলতি বছরের জুন মাসে ওয়ারপোর অনুমোদন পায়।

গবেষণায় উঠে এসেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে পরিস্থিতি আগের চেয়ে প্রতিদিনই খারাপ হচ্ছে। পানি সংকটাপন্ন এলাকা বাড়ছে। গবেষণার তথ্যমতে, ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ২৬ ফুট নিচে। সে সময় সর্বোচ্চ তানোরে পানির স্তর নেমেছিল ৬৮ ফুট। খাবার পানি, সেচ, মাছ চাষের মতো বিভিন্ন কাজে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় ২০১০ সালে পানির গড় ছিল ৫০ ফুট নিচে। ২০২১ সালে ভূগর্ভস্থ পানির গড় আরও নিচে নেমে দাঁড়ায় ৬০ ফুটে। একই বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের একটি স্থানে ভূপৃষ্ঠ থেকে মাটির নিচে পানি নামে ১৫৩ ফুট। গবেষণার তথ্যমতে, এ অঞ্চলের ২১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮৭টি ইউনিয়ন অতি উচ্চ ও উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা। পানির স্তর সবচেয়ে বেশি নেমেছে পোরশার ৬ ও নাচোলের চার ইউনিয়নে। অতি উচ্চ পানি সংকটে গোদাগাড়ি, তানোর, গোমস্তাপুর, নিয়ামতপুর ও সাপাহারসহ ৯ উপজেলার ৩৭টি ইউনিয়ন। গবেষণায় ৪০টি ইউনিয়নকে ‘উচ্চ পানি সংকটাপন্ন’ ও ৬৫টি ইউনিয়নকে ‘মাঝারি পানি সংকটাপন্ন’ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা। এদিকে, নওগাঁর কয়েকটি স্থানে ১৫০০ ফুট মাটির নিচেও মেলেনি ভূগর্ভস্থ সিক্ত শিলাস্তর। তানোরসহ আশপাশে একটি মাত্র পাতলা ৫০ ফুটের অ্যাকুইফার (সচ্ছিদ্র শিলাস্তর) পানির উৎস হিসেবে কাজ করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানির পুনর্ভরণ না হওয়ায় দেখা দিয়েছে সংকট।

বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ায় ওই অঞ্চলের মানুষে নানান দুর্ভোগের তথ্য নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো রিপোর্ট নিচে তুলে ধরা হলো।

রাজশাহী থেকে রেজাউল করিম রাজু জানান, বর্ষাকালেও নেই ভারী বর্ষণ। আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবণ যায় যায় তারপরও দেখা নেই কাঙ্খিত বৃষ্টির। শ্রাবণে, চৈত্র-বৈশাখের খরা ভাব। প্রচ- খরতাপ। খাঁ খাঁ করছে প্রকৃতি। শ্রাবণে তাপমাত্রা দাঁড়িয়েছে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়ার এমন আচরণের বিরূপ প্রভাব পড়েছে জনজীবন আর প্রকৃতিতে। চাষাবাদ চরমভাবে বিঘিœত হচ্ছে। পাট কেটে তা পচানো যাচ্ছে না। আমনের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তারপর বৃষ্টির অভাবে আবাদ করা যাচ্ছে না। আমন আবাদ বৃষ্টি নির্ভর ফসল। বর্ষাকালের বৃষ্টিতে হয় আবাদ। কিন্তু বেশ ক’বছর ধরে গভীর নলকুপের পানি তুলে আবাদ করতে হচ্ছে। আগে কৃষক আমন আবাদে বৃষ্টির পানিকে আল্লাহর রহমতের বোনাস হিসেবে দেখত। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সব হিসেব উল্টে গেছে। সব আবাদের জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে সেচের ওপর। আর সেচ মানে নিচ থেকে পানি তোলা। বরেন্দ্র অঞ্চলের এক ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করতে গিয়ে হাজার হাজার গভীর নলকুপ দিয়ে তোলা হচ্ছে পানি। এতে করে বরেন্দ্রের পেট খালি হয়ে গেছে। অকাতরে পানি তোলা হলেও বৃষ্টিহীনতার কারণে তা পুনঃভরণ হচ্ছে না। তাছাড়া এ অঞ্চলের লাইফ লাইন হিসেবে খ্যাত পদ্মা নদীকে ভারতের মালদহে ফারাক্কার নামে ব্যারেজ দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। শুধু পদ্মা মরেনি মরেছে এর অসংখ্য শাখা নদ-নদী। খাল-বিল ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস সংকুচিত হয়েছে। খাদ্য যোগান দিতে গিয়ে নিচের পানিতে হাত দিতে দিতে পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে গভীর নলকূপের পানিতে টান ধরেছে। পানির স্তর নীচে নামতে নামতে তলানীতে ঠেকেছে। হস্তচালিত নলকূপে পানি ওঠা সেই কবে বন্ধ হয়েছে। সাবমার্সেবল পাম্পেও পানি ওঠে না। ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে খরায় পানির সংকট চরমে। খাল-বিল-পুকুর-ডোবা শীত আসার আগেই শুকিয়ে যায়। ফলে সব কিছুতেই ব্যবহার করা হয় গভীর নলকূপের পানি। বিপুলহারে পানি তোলা ও অনাবৃষ্টির কারণে পুনঃভরণ না হওয়ায় বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের ও খবার পানির তীব্র সংকট শুরু হয়েছে। ওয়াটার রির্সোস প্লানিং অর্গানাইজেশন বরেন্দ্র অঞ্চলে এক সমীক্ষা চালিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে বরেন্দ্র অঞ্চলের চল্লিশভাগ এলাকা পানি সংকটাপন্ন। এ অঞ্চলের ২১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮৭ ইউনিয়নকে অতি উচ্চ ও উচ্চপানি সংকটাপন্ন হিসেবে চিহিৃত করা হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহী চাপাইনবাবগঞ্জ ও নওগা জেলাজুড়ে গবেষণা করে এমন কথা জানানো হয়েছে। গবেষণাপত্রে বিকল্প হিসেবে ভূপৃষ্ট ও ভূগর্ভস্থ পানির সম্মিলিত ব্যবহার উৎসাহিত করা হয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগর্ভস্থ খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সাবেক প্রো-ভিসি চৌধুরী সরওয়ার জাহান সজল যিনি দীর্ঘদিন ধরে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন বরেন্দ্র অঞ্চলের পানির স্তর খুব দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। ১৯৯০ সালে এ অঞ্চলের গড় পানির স্তর ছিল আট মিটার। সেচ ধান, খাবার পানি, মাছ চাষ, আম চাষ এবং শিল্পের অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ওঠানোর কারণে ২০১০ সালে পানির গড় স্তর পনের মিটার দাঁড়িয়ে যায়। ২০২১ সালে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হয় আঠারো মিটার।

বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বলছেন তারা মূলত দেশের খাদ্য যোগান দিতে এক ফসলি ধানের জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করে খাদ্যের যোগান দিয়েছেন। এখন শুধু ধান নয় সব কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি। ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহারের কথা বলা হলেও এর উৎস সংকুচিত হয়ে গেছে।

বগুড়া থেকে মহসিন রাজু জানান, এ জেলায় বর্তমানে সুপেয় পানির সংকট তীব্রতর রূপ নিয়েছে। বগুড়া শহর ও শহরতলী এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এতটাই নিচে নেমে গেছে যে হস্তচালিত টিউবওয়েলে আর পানি উঠছেই না। এক দশক আগেই বগুড়ার মাঝ বরাবর বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরের উঁচু এলাকায় (বরেন্দ্র বা লালমাটি) হস্তচালিত টিউবওয়েলে পানি ওঠা বন্ধ হয়। এই এলাকাভুক্ত এলাকায় সুপেয় পানির জন্য মাটির গভীরে সাবমার্সিবল পাম্প বসাতে হচ্ছে। এটা মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা এর শামিল। তবে বর্তমানে করতোয়া নদীর পূর্বপাড়ের নিচু এলাকায়ও পানিস্তর নিচে নেমে যাওয়ায় আর আগের মতো হস্তচালিত টিউবওয়েলে পানি উঠছে না বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। বগুড়া পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর পরিমল চন্দ্র দাস এ প্রসঙ্গে বলেন, পৌর কর্তৃপক্ষ শহরবাসীকে সুপেয় পানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে পানির স্তর এখন এতটাই নিম্নগামী যে পৌর কর্তৃপক্ষের পক্ষেও শতভাগ পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। বগুড়ার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তর সুত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, বগুড়ায় ৮০ এর দশক থেকেই অনাবৃষ্টি, খাল, বিল, পুকুর, জলাশয় ভরাটের কারণে এবং চাষাবাদের কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারের কারণে নিচে নামতে থাকে ভূগর্ভস্থ পানিস্তর। বর্তমানে বগুড়া শহরের পানিস্তর নেমে গেছে ৮০ ফিটের নিচে। এই স্তরের পানি হস্তচালিত টিউবওয়েল দ্বারা পাওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে শতশত টিউবওয়েল এখন অচল হয়ে পড়ে আছে। সুপেয় পানির সংকট তীব্রতর হচ্ছে। দেশের বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ও পল্লী উন্নয়ন একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক আব্দুল মতিন জানান, বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকে খাল-বিল ভরাটের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। সেচকাজে ভূগর্ভস্ত পানির ব্যাবহার কমাতে হবে। এছাড়াও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে সেটা সারাবছর যেন সুপেয় পানির চাহিদা পুরণ করতে পারে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

দিনাজপুর থেকে মাহফুজুল হক আনার জানান, বিশ ফুটের একটি পাইপ, একটি ফিল্টার আর উপরিভাগে টিউবওয়েল হলেই সুপেয় খাবার পানির ব্যবস্থা হয়ে যেতো। হাফ হর্সের একটি মোটর পাম্প হলে দ্বিতল বাড়ির টেংকিতে পানি তোলা যেত অনায়াসে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তিনটি পাইপ বসিয়েও কাঙ্খিত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পাকাবাড়ির মালিকেরা এখন পাম্প পরিবর্তন করে এক থেকে দুই হর্সের মোটর লাগাতে বাধ্য হচ্ছে। তারপরও সঠিক পরিমাণ পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। কারণ একটাই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। কৃষি কাজের সেচের জন্য এখন ১০ ফুট গর্তে পাম্প বসিয়েও পানি তোলা যাচ্ছে না। বসাতে হচ্ছে ৮০ থেকে ১শ’ ফুট পাইপ। ফলে বাড়ছে খরচ। অনাবৃষ্টির কারণে ভরা বর্ষা মৌসুমেও খাল বিলগুলো প্রায় পানি শূন্য। পাট পচানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে সেচ। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে অনাবৃষ্টি, মাত্রাতিরিক্ত উঞ্চতা ও সেচের ব্যবহারসহ বায়ুম-লের পরিবর্তন। যা প্রতিনিয়ত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

দেশের উঁচু এলাকা হিসেবে পরিচিত দিনাজপুর ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলায় এলাকা ভেদে ২৫ থেকে ৩০ ফুট গভীরে পাইপ বসিয়ে টিউবওয়েলের সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থা গত ৫-৬ বছর ধরে। খরা মৌসুমে পানির জন্য এমন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। চলতি বছর খরা মৌসুমে একেবারেই অচল হয়ে গেছে অধিকাংশ হস্তচালিত টিউবওয়েল। ভরা মৌসুমে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে যা সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। ৩০-৩৫ ফুট গভীর থেকে হস্তচালিত নলকূপের পানি উঠছে। কিন্তু এর নিচে গেলেই পানি উঠছে না। বড় বড় হাইরাইজ ভবনের পানি তুলতে ব্যবহার করতে হচ্ছে বড় বড় পাম্প।

দিনাজপুর সদরের দক্ষিণ কোতয়ালী, বীরগঞ্জ ও পার্বতীপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় শীত ও খরা মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়। ১৮০ ফুট গভীরে পাইপ বসিয়ে পানি পাওয়া যায় না ঠিকমতো। গ্রামাঞ্চলে একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ায় ডিপ-টিউবওয়েল থেকে দূরে গিয়ে ডিপ-টিউবওয়েল থেকে পানি আনি। জানালেন এলাকার প্রায় সবার বাড়িতে পানি সংরক্ষণের জন্য আলাদা বালতি ও ড্রাম রাখা আছে। সম্প্রতি মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের মাহানপুর, শীলপাড়া, মাস্টারপাড়া, সেনপাড়া, নদুডাঙ্গী, কর্মকারপাড়া, নিপুনপাড়া, চকপাইকপাড়া, শিবডাঙ্গী এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে একই তথ্য পাওয়া যায়।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর দিনাজপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী এ এন মো. নাইমুল এহসান এর কাছে পানির স্তর নেমে যাওয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বায়ুম-লের পরিবর্তন, কম বৃষ্টিপাত, অতিরিক্ত তাপদাহ সব মিলিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি নেমে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। তার মতে কম বৃষ্টিপাতের কারণে নদী-নালা-খাল-বিল পানি শূন্য হয়ে থাকছে। সেচ কাজে ভূ-গর্ভের পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এ জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে আমাদের আরো সাবধানী ও সচেতন হতে হবে।

রংপুর থেকে হালিম আনছারী জানান, রংপুর অঞ্চলের সর্বত্রই চলছে প্রচ- তাপদাহ। আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবণের শেষ নাগাদ এসেও কাক্সিক্ষত বৃষ্টির দেখা মিলছে না। পানির অভাবে সর্বত্রই প্রায় হাহাকার অবস্থা বিরাজ করছে। বর্ষাকালেও নদ-নদীতে পানি নেই। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নলকূপগুলোতেও পানি উঠছে কম। বেশির ভাগ নলকূপ থেকেই পর্যাপ্ত পানি উঠছে না । পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাব এবং সেচ কাজসহ ভূগর্ভস্থ পানির যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে রংপুর অঞ্চলে পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে।

একের পর এক পুকুর জলাশয় ভরাট করে কৃষি জমি কিংবা আবাসিক ঘর-বাড়ি তৈরি করায় ক্রমান্বয়েই পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। রংপুরের বিভিন্ন এলাকায় ইতঃপূর্বে ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীরে গেলেই পানির স্তর পাওয়া যেত। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বর্তমানে ২৫-৩০ ফুটের নিচে পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে না।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও বিএডিসির কর্মকর্তাদের মতে, বেশ কিছুদিন ধরে ভারী বৃষ্টি না হওয়ায় বিশেষ করে বর্ষার মওসুমেও পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে রোপা আমনসহ বিভিন্ন ফসলি জমিতে সেচ দেওয়া এবং তাপদাহ বেড়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে অনেক স্থানেই নলকূপগুলো থেকে পর্যাপ্ত পানি উঠছে না।

ঠাকুরগাঁও থেকে মাসুদ রানা পলক জানান, জেলার সদর উপজেলার চারটি ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের নলকূপে মিলছে না সুপেয় খাবার পানি। প্রয়োজন মেটাতে অনেকেই কুয়ার পানি ব্যবহার শুরু করলেও কিছুদিন যেতে না যেতেই সেখানেও একই অবস্থা। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে গ্রামগুলোর কয়েক হাজার পরিবার। সরেজমিনে সদর উপজেলার আকচা, জগন্নাথপুর, সালন্দর, শুখানপুকুরী ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে গিয়ে পানি সংকটের বিষয়টি নজরে পড়ে। এসব ইউনিয়নের বেশ কিছু গ্রামে এ সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে।

ঠাকুরগাঁও জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জানিয়েছে, এসব এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। বেশ কয়েক বছর আগেও ৬০ বা ৯০ ফুট গভীরে পানির স্তর মিললেও এখন ১৫০ ফুট গভীরেও মিলছে না। এতে করে অচল হয়ে পড়েছে নলকূপগুলো। কিছু নলকূপে পানি মিললেও তা পর্যাপ্ত নয়।

https://dailyinqilab.com/national/article/592432