৪ আগস্ট ২০২৩, শুক্রবার, ১:০৮

অব্যবস্থাপনায় ফ্লাইওভারে যানজট

টোলবুথে অধিক সময় ব্যয় গুলিস্তান প্রান্তে বাসগুলো এলোপাতাড়িভাবে ঘুরে
যানজট ঢাকাবাসীর জন্য যেন এক অভিশাপ। যানজটের ভয়াবহ দুর্ভোগ লাগবের লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নেয়ার পরও তা কিছুতেই দূর হচ্ছে না। উল্টো যানজটের দুর্বিসহ যন্ত্রণা দিনদিন বেড়েই চলেছে। ট্রাফিক পুলিশের যথাযথ দায়িত্বপালন না করা, গাড়িচালকদের নিয়ম না মানার প্রবণতা এসব অনিয়ম ও অবব্যস্থাপনার জন্য দিন দিন যানজট আরও বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

যানজটের ক্ষতি অপূরণীয়। যানজটের কারণে যানবাহনের গতিবেগ ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটারের নিচে নেমে এসেছে। ফলে যে কোনো কাজে বের হলে মানুষের দ্বিগুণ-তিনগুণ সময় লাগছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নগরবাসী। ভয়াবহ এই যানজটের কারণে প্রতি মাসে ৫০ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে কর্মজীবীদের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জিডিপিতে। এক গবেষণায় উঠে এসেছে বছরে রাজধানীর যানজটের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ডিসেম্বরে প্রকাশিত এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরে যানজটের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৯ শতাংশ।

রাজধানীর এই অসহনীয় যানজটের ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে নির্মাণ করা হয় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার। কিন্তু যে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয় যানজট কমানোর জন্য সেই ফ্লাইওভারেই লেগে থাকে যানজট। এই যানজট যেন নিত্যদিনের ঘটনা। দূরদুরান্ত থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি অথবা যাত্রীবাহী গাড়ি এসে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে উঠলেই পড়তে হচ্ছে যানজটে। প্রতিদিন একই অবস্থায় যানজটে পড়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এই পথে চলাচলকারী লোকজনকে। তারা মনে করছেন যানজট থেকে মুক্তির জন্য ফ্লাইওভারে উঠলে আরো ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

যানজট থেকে মুক্তির জন্য মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে উঠলেও সেখানে গিয়ে আরও বড় যানজটের মুখে পড়েছেন গাড়ি চালক ও যাত্রীরা। ফ্লাইওভারের উপর গাড়ি স্থবির হয়ে পড়লে যাত্রীদের বাস থেকে নেমে হেঁটে যেতে দেখা যায়। গতকাল বৃহস্পতিবার যাত্রাবাড়ী থেকে পলাশী পর্যন্ত রাজধানীর সবচেয়ে বড় ফ্লাইওভাবে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ধারণ ক্ষমতার তুলনায় গাড়ি চলাচল বেড়ে যাওয়া এবং গুলিস্তান প্রান্তে টোল আদায়ের সময় আস্তে আস্তে গাড়ি সামনের দিকে যাওয়ায় এ যানজট সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ফ্লাইওভারের মুখসহ উপরের বিভিন্ন স্থানে বাস ও টেম্পু দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো, বিভিন্ন যানবাহনকে ফ্লাইওভারে উঠতে বাধ্য করা, টোলবুথে অধিক সময় ব্যয় করাসহ নানা কারণে এ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে টাকা দিয়ে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে চলতে গিয়ে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। হানিফ ফ্লাইওভার থেকে নামতে গিয়েও ভয়াবহ যানজট এখন নিত্যসঙ্গী। ফ্লাইওভারের গুলিস্তান প্রান্তে বাসগুলো এলোপাতাড়িভাবে ঘুরতে গিয়ে যানজটের সৃষ্টি করে।

সরেজমিন দেখা যায়, প্রায় প্রতিদিনই সায়েদাবাদ থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয় গণপরিবহন। ফলে যাত্রীরা যে উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত টাকা দিচ্ছেন, সে সুফল পাচ্ছেন না। গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার থেকে যানবাহন নামতে গেলেই যানজট। গুলিস্তান পয়েন্টে প্রতিদিন যানজট লাগছে। কখনো কখনো সে যানজট ফ্লাইওভারের পেছনে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ হয়। এ যেন ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ভোগান্তি কেনা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে যেসব লোকাল বাস আসছে, ফ্লাইওভারের প্রবেশমুখে সেগুলো যাত্রী ওঠানামা করানোর জন্য দাঁড়াচ্ছে। এতে করে ফ্লাইওভারের প্রবেশমুখে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। সন্ধ্যা হলেই গোলাপবাগে নামতে গিয়েও প্রতিদিন যানজটে আটকে থাকতে হয়। একই সময় ফ্লাইওভারের মুখেই নিচের রাস্তার গাড়িগুলো ঘুরানো হয়। এজন্য ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়।

যাত্রাবাড়ী-ডেমরা, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, পদ্মা সেতু হয়ে ধোলাইপাড় দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করা যাত্রী এবং আশপাশের এলাকা থেকে এ পথে নিয়মিত অফিস করা যাত্রীদের কাছে গুলিস্তানের যানজট এখন আতঙ্ক। পিক আওয়ারে হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর প্রায়ই সৃষ্টি হয় কয়েক কিলোমিটার লম্বা যানজট। হানিফ ফ্লাইওভার থেকে নামার পর আশপাশের রাস্তাগুলোর সব কয়টি ফুটপাথ দখল করে রেখেছে অসাধু চক্র। ফুটপাথে দোকানপাট বসানোর পাশাপাশি রাস্তার ওপরও কয়েক সারিতে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন হকাররা। অবৈধ দখলে রাস্তা সরু হয়ে যাওয়ায় যান চলাচল মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফ্লাইওভার থেকে নেমে এই অল্প একটু সড়কে প্রতিবন্ধকতার কারণে গাড়িগুলোকে এই এলাকা ছেড়ে যেতে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। এর প্রভাব পড়তে থাকে হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর। দীর্ঘ হতে থাকে পেছনের যানবাহনের সারি। টোল প্লাজায় টোল সংগ্রহে ধীর গতিও যানজটের জন্য দায়ী।
মেঘলা পরিবহনের এক চালক বলেন, এই ফ্লাইওভার দিয়েই নিয়মিত চলাচল করি। টোল দেয়ার আগে আধা ঘণ্টা জ্যামে আটকা পড়তে হয়। টাকা দিয়ে ব্রিজে উঠে আবার যানজটে পড়তে হচ্ছে। উপর দিয়ে গেলেও যানজটে পড়তে হচ্ছে নিচে দিয়া গেলেও যানজটে পড়তে হচ্ছে।

রায়েরবাগের বাসিন্দা আবুল হোসেন। তিনি ব্যবসা করেন গুলিস্তান ইলেট্রিক মার্কেটে। প্রতিদিন যাতায়াত করেন এই পথ দিয়ে। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, হানিফ ফ্লাইওভার হয়ে গুলিস্তানের আসতে প্রতিদিনই ফ্লাইওভারের উপর যানজটে আটকে থাকতে হয়। টোল আদায়ের সময় এই যানজট আরো বেড়ে যায়।

দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ফ্লাইওভারের মুখে সব সময় লোকাল বাস দাঁড়িয়ে থাকে। এতে করে মহাসড়ক ধরে আসা গাড়িগুলো ফ্লাইওভারে প্রবেশ করতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এক পর্যায়ে তা ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি করে।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিকের পুলিশ পরিদর্শক (শহর ও যানবাহন) মো. আহসান হাবিব প্রামানিক ইনকিলাবকে বলেন, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে যানজট কয়েকটি কারণে হয়ে থাকে। এর মধ্যে টোল দেয়ার সময় প্রত্যেক গাড়িকে কিছুটা সময় এখানে থাকার কারণে পেছনের গাড়িগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এছাড়া গুলিস্তানে নামার সময় ফুটপাথে হকার ও দোকান থাকার কারণে গাড়িগুলো গতি নিয়ে চলতে পারে না তাই এখানেও যানজট সৃষ্টি হয়। আর এই যানজট আস্তে আস্তে ফ্লাইওভারের উপর পর্যন্ত চলে যায়।

https://dailyinqilab.com/national/article/592181