২৫ জুলাই ২০২৩, মঙ্গলবার, ১:২০

সঙ্কট দক্ষ জনবল

বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রফতানি করলেও এদেশেই কাজ করছেন বিপুল সংখ্যক বিদেশিকর্মী। সরকারি হিসেবে সেটি এক লাখ বলা হলেও এটির প্রকৃত সংখ্যা ৫ লাখের বেশি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। দুই বছর আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ২১টি খাতে ৪৪টি দেশের আড়াই লাখ কর্মী কাজ করছেন। যারা বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর নিয়ে যাচ্ছেন ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী ও জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগি, দক্ষতাভিত্তিক না হওয়ার কারণে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নিয়ে বের হলেও শিল্প প্রতিষ্ঠানে যে রকম দক্ষকর্মী প্রয়োজন সেটির চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। কারিগরি শিক্ষার দক্ষতার অভাবে বহিঃবিশ্বের বাজারেও অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। ফলে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই অদক্ষ শ্রমিক। আগামী দিনে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, প্রযুক্তি, রোবটিক ও আইওটির (ইন্টারনেট অব থিংস) যুগে টিকে থাকতে হলে সকল জনশক্তিকে কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার তাগিদ দিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র, শিক্ষা, শ্রম ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

গোটা বিশ্বই এখন প্রস্তুত হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য। কারণ প্রযুক্তির এই বিপ্লবে বিপ্লব ঘটবে মানুষের জীবনমান, পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত হবে শিল্প, অর্থনীতি, যোগাযোগ। সবকিছুর কেন্দ্রে থাকবে মেশিন, রোবট, ইন্টারনেট অব থিংক (আইওটি)সহ প্রযুক্তির নতুন নতুন সব উদ্ভাবন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ জনশক্তির চাহিদাও বাড়ছে দিনে দিনে। এজন্য প্রযুক্তির এসব উদ্ভাবন ও পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে উন্নত দেশগুলো উন্নত যুগোপযোগী শিক্ষায়, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। জার্মানিতে ৭৩, জাপানে ৬৬, সিঙ্গাপুরে ৬৫, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০, চীনে ৫৫, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০ শতাংশ মানুষ কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ। সব উন্নত দেশে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলামও তৈরি করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা যতটা এগুচ্ছে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে ততটাই। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিদিনই দক্ষ কর্মীর চাহিদা বাড়লেও কেবল প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশ এই বাজার ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করেন তারা। পিছিয়ে পড়ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও নেপাল থেকেও। যদিও প্রতি বছরই ৬ থেকে ৮ লাখ জনশক্তি রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মাধ্যমও তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সই।

শিক্ষাবিদ ও জনশক্তি রপ্তানিকারকরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের যদি প্রয়োজনভিত্তিক, দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা দেয়া যায় এবং যারা বিদেশের শ্রমবাজারে যাচ্ছেন তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলা যায় তাহলে এই চিত্র পরিবর্তন হতে পারে। এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. এ বি এম রাশেদুল হাসান বলেন, এখন আর গতানুগতিক ধারার শিক্ষায় কিছু হবে না। আমাদের নজর দিতে হবে বিশ্ব কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে, কি ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে, কেমন দক্ষতা প্রয়োজন? কারণ এখনই মেশিন হিউম্যান রিসোর্সের জায়গা নিচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রযুক্তির কল্যাণে সামনের দিনে যে চ্যালেঞ্জ আসছে সেটিকে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন হবে কারিগরি শিক্ষা, কম্পিউটারের দক্ষতা। এর কোনো বিকল্প নেই।

পার্শ্ববর্তী দেশের উদাহরণ দিয়ে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ভারত তাদের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউশন ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দেয়ার কারণে এখন তারা এই ক্ষেত্রে এগিয়েছে, অনেক জায়গায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের ভুড়ি ভুড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো দরকার নেই। কৃষিতে, শিল্পে যেরকম প্রয়োজন, তেমন দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের তথ্যমতে, কারিগরি শিক্ষার হার প্রায় ২০ শতাংশ।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্য মতে, প্রতিবছর কয়েক লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। যাদের বেশিরভাগই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। ফলে প্রশাসনিক পদে থাকছে বিপুল প্রতিযোগিতা থাকলেও কর্মক্ষেত্রে যে ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন সেটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে না থাকায় বিভিন্ন কর্পোরেট সেক্টর ও বেসরকারি সংস্থাকে বিদেশ থেকে লোক আনতে হচ্ছে।

জানা যায়, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেলেও দেশে ভালো চাকরির নিশ্চয়তা নেই। উচ্চশিক্ষায় দুর্দান্ত ফল অর্জনকারীদের মধ্যে ২ থেকে সাড়ে ৩৪ শতাংশ বেকার। আবার যারা চাকরি পান, তাদের ৭৫ শতাংশেরই বেতন চল্লিশ হাজার টাকার নিচে। উচ্চশিক্ষিত মেধাবীদের চাকরি, বেতন ও বেকারত্বের এ হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক গবেষণায়। ওই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, শিক্ষিতদের (এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী) এক-তৃতীয়াংশই বেকার। তাদের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার বেশি অর্থাৎ যাদের পেছনে দেশ ও পরিবার বেশি অর্থ ব্যয় করেছে, তারাই বেশি বেকার।

বিআইডিএসের গবেষণা অনুযায়ী, সার্বিকভাবে শিক্ষিতদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের বেশি বেকার। আর এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যারা প্রথম শ্রেণি পেয়েছে, তাদের মধ্যে বেকারত্ব ১৯ থেকে সাড়ে ৩৪ শতাংশ। বিশেষ করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশই বেকার। স্নাতক পর্যায়ে এমন মেধাবীদের বেকারত্বের হার প্রায় ২৮ শতাংশ।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের কর্মবাজারের উপযোগী কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কর্মবাজারের উপযোগী করতে কারিগরি শিক্ষাকে সুলভ ও আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করছে সরকার। দেশের প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে একটি করে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে। সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের বৃত্তিমূলক দক্ষতা দেওয়ার জন্য শিক্ষাক্রমে কারিগরি কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, শিল্পকারখানা ও ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অনুযায়ী কারিগরি শিক্ষানীতি, কারিকুলাম প্রণয়ন ও জব ম্যাচিং করে কারিগরি শিক্ষাকে আরও কর্মমুখী করতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। দেশের সাধারণ জনগণের কাছে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে এর ভূমিকা তুলে ধরার পাশাপাশি এ শিক্ষা নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করা সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্বয় বাড়াতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিগত দেড় যুগের বেশি সময় ধরে সাধারণ বিষয় ও বাণিজ্যের বেশি কিছু বিষয়ে (বিবিএ, এমবিএ, বিএ, এমএ, অনার্স, মাস্টার্স) উচ্চ শিক্ষার মাত্রা ছিল অনেক বেশি। যাদের কারিগরি কোনো দক্ষতা ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে কারিগরি শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ছে। অন্যদিকে বৈদেশিক কর্মসংস্থানগুলো ১১০টি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে দেয়া হচ্ছে দক্ষতাভিত্তিক কারিগরি প্রশিক্ষণ।

তবে দেশে ও বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের মান মোটামুটি থাকলেও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণভাবে মানসম্মত নয়। টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারগুলোও পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় দক্ষতাসম্পন্ন জনবল তৈরি করতে পারছে না। ফলে বিদেশে গিয়ে এদেশের কর্মীদের কম বেতনে চাকরি করতে হচ্ছে। অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি বিদেশে কাজ করে দ্বিগুণেরও বেশি অর্থ উপার্জন করছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও গার্মেন্ট শিল্পেও ভারতের লোকজন অ্যাডভাইজার হিসেবে উচ্চ বেতনে কাজ করছে। সেখানে আমাদের অদক্ষ শ্রমিকরা তাদের অধীনে চাকরি করছে খুবই কম বেতনে।
হাতছাড়া হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বাজার:

ইউরোপের দেশগুলোতে দক্ষ বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশি যুবকদের দক্ষতা অর্জনে সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ উদ্যোগের অভাবে দক্ষ জনশক্তি রফতানিতে দেশ পিছিয়ে আছে। ইউরোপের শ্রমবাজার হাত ছাড়া হচ্ছে। দালাল চক্রের খপ্পরে পড়েও বহু অদক্ষ যুবক লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে সাগর পথে ইউরোপে ঢুকার চেষ্টা করে অনেকে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। আবার ভূমধ্যসাগরে ধরা পড়ে লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ দিন যাবৎ কারাবন্দি দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। দেশের টিটিসিগুলো নানা কারণে আশানুরূপ দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে না। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. আহমদ মনিরুছ সালেহীন বলেন, দক্ষ জনশক্তি বিদেশে পাঠাতে পারলে প্রবাসীকর্মীরা দিগুণ মজুরি লাভের সুযোগ পেতো। এতে রেমিট্যান্সেও অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হতো। সচিব বলেন, টিটিসিগুলোর মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরির প্রচেষ্টা চলছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় ৯০% অদক্ষ কর্মীই চাকরি নিয়ে যাচ্ছে। দক্ষ কর্মী তৈরি করে বিদেশে পাঠাতে পারলে দ্বিগুণ মজুরি লাভ করা সম্ভব।

তিনি বলেন, দক্ষ জনশক্তির চাহিদা গোটা বিশ্বজুড়েই বাড়ছে। অদক্ষ কর্মীর চেয়ে দক্ষ কর্মী তৈরি করে বিদেশে পাঠাতে পারলে আমাদের কর্মীরা দ্বিগুণ মজুরি লাভ করার সুযোগ পেতেন। এতে রেমিট্যান্স খাতেও আরো বড় সাফল্য অর্জিত হতো বলে সিনিয়র সচিব উল্লেখ করেন। বিএমইটির টিটিসিগুলোর মাধ্যমে আমাদের কর্মীদের দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষিত এসব কর্মী কিছু দিন অভিজ্ঞতা অর্জন করে বিদেশে গিয়ে ভালো বেতনেও কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিদেশগমনেচ্ছু কর্মীদের দক্ষতা অর্জনে সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে সিনিয়র সচিব বলেন, কোরিয়া ও জাপানের ভাষা শিক্ষা দেয়ার নামে অনুমোদনহীন কিছু বেসরকারি ভুইফোঁড় প্রতিষ্ঠান চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি এবং মুখরোচক বিজ্ঞাপন দিয়ে যুবকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব ভুইফোঁড় প্রতিষ্ঠান মানসম্পন্ন কোরিয়ান ও জাপানি ভাষা শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউরোপের দেশ পোল্যান্ডে প্রায় ১৫ হাজার বাংলাদেশি নাগরিকের বসবাস এবং আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, দেশটিতে বাংলাদেশিদের মালিকানায় গড়ে উঠা রেস্টুরেন্টের সংখ্যা বর্তমানে এক হাজারেরও বেশি। সুন্দর এই দেশটি বাংলাদেশিদের জন্য একটি উদ্যোক্তার দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে পোল্যান্ড এবং জার্মানি হতে পারে একটি প্রধান শ্রমবাজার। কেননা জার্মানিও চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রায় ৬০ হাজার দক্ষ জনশক্তির চাহিদার ঘোষণা দিয়েছে।

সরকার পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়াশোস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে জনবল বৃদ্ধি ও লেবার কাউন্সিলর নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারটি বিবেচনায় নিলে দেশটিতে বাংলাদেশি জনশক্তি রফতানির কাজটি সহজ হতে পারে। গতকাল সোমবার পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশো থেকে সফররত তাফা হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্টের স্বত্বাধিকারী ড. মামুন আশরাফী ইনকিলাবের সাথে আলাপকালে এ অভিমত ব্যক্ত করেন। ড. মামুন আশরাফী বলেন, পোল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রচুর দক্ষ বাংলাদেশি কর্র্মীর চাহিদা রয়েছে। পোল্যান্ডের নিয়োগকারীরা ওয়েল্ডার, ইঞ্জিনিয়ার, প্লাম্বার, পাইপ ফিটারসহ বিভিন্ন ট্যাকনেশিয়ান নিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। ইউরোপের শ্রমবাজারে অবাধে প্রবেশের সুযোগ কাজে লাগাতে দক্ষ বাংলাদেশি গড়ে তোলার ব্যাপারে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যেহেতু পোল্যান্ডের কোনো দূতাবাস নেই, তাই আমাদের নাগরিকদের ভিসার আবেদনপত্র জমা দিতে যেতে হয় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এবং সেখানে প্রায় এক মাস অবস্থান করতে হয়। যা অত্যন্ত ব্যয় সাপেক্ষ। অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের মতো পোল্যান্ডের ভিসা আবেদনপত্রও যদি ভিএফএসের (ভিসা ফ্যাসিলিটেশন সেন্টার) মাধ্যমে ঢাকায় জমা নেয়ার ব্যবস্থা করা যেতো তাহলে বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসা আবেদনের খরচ কমে যেত অনেকাংশে এবং তাদের মূল্যবান সময় বেঁচে যেতো। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি পোলিশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে আশু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে জনশক্তি রফতানি সহজীকরণে যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করবে বলেও তাফা হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্টে স্বত্বাধিকারী ড. মামুন আশরাফ আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

তিনি ইউরোপের শ্রমবাজারে কর্মী নিয়োগের চাহিদা খুঁজে বের করার লক্ষ্যে গত ৬ মার্চ পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতের সাথে তার অফিসে এক বৈঠকে অংশ নেন। রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের শ্রমিকদের চাকরির সুযোগ খোঁজার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকদের একটি অংশ ভিন্ন দেশে চলে যাওয়ার ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ওই সময়ে রাষ্ট্রদূত ইউরোপের শ্রমবাজারে দক্ষ শ্রমিকদের চাকরির চাহিদার ব্যাপারে একমত প্রকাশ করেন। বৈঠকে উপস্থিত পোলিশ চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ ওয়েল্ডার এবং কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের (সফটওয়ার ও হার্ডওয়ার) কর্মসংস্থানের জন্য একটি চাহিদাপত্র প্রদান করে। উক্ত কোম্পানির সব কাগজপত্র এবং চাহিদাকৃত ওয়েল্ডার ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারদের কর্মস্থল, কর্মপরিবেশ এবং থাকার জায়গা দূতাবাসের মাধ্যমে পরীক্ষা, পরিদর্শন ও সত্যায়িত করাতে চাইলে রাষ্ট্রদূত দূতাবাসের জনবলের অপ্রতুলতার কথা প্রকাশ করনে। রাষ্ট্রদূত ব্যাপারটি দেখবেন বলেও আশ্বস্ত করেন।

একইভাবে সউদী আরব, আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, বাহরাইন, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তির চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশের পরিবর্তে তারা ভারত ও পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশ থেকে চাহিদা পুরণ করছে।
বেকারত্বের হার কমাতে আওয়ামী লীগ সরকার কারিগরি শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপি। তিনি বলেন, বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে মানবসম্পদের উন্নয়ন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কেবল কারিগরি শিক্ষার সাহায্যে স্বল্প সময়ে বিপুল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা সম্ভব। তাই ছাত্র-শিক্ষকসহ সকলকে কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। যে দেশে কারিগরি শিক্ষার হার যত বেশি, সে দেশের মাথাপিছু আয় তত বেশি। তাই আওয়ামী লীগ সরকার বেকারত্ব কমাতে কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব আরোপ করেছে।

https://dailyinqilab.com/national/article/589835