২৩ জুলাই ২০২৩, রবিবার, ৩:৪৭

৯৯ শতাংশ হাসপাতাল হিসাবের বাইরে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুর তথ্য অপূর্ণাঙ্গ

ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েই চলেছে, এতে চাপ বেড়েছে হাসপাতালগুলোতে। ছবিটি সোমবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল থেকে তোলা। ছবি: ফোকাস বাংলা

প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে হিসাব দিয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সেটি পূর্ণাঙ্গ নয়। সরকারি-বেসরকারি মিলে মোট হাসপাতালের ১ দশমিক ৩২ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর তথ্য প্রকাশ করছে সরকারি এ সংস্থাটি। বাকি ৯৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগীর তথ্য অন্ধকারে থেকে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আংশিক ওই তথ্যকে পূর্ণাঙ্গ ধরে প্রকাশ করা অনৈতিক। এতে রোগ নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়। এরকম লুকোচুরিতে গোপনে মহামারিও দেখা দিতে পারে। এ বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ মহামারি পর্যায়ে রয়েছে। পরিস্থিতি এবং আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা এবার সর্বোচ্চ হতে পারে। তবে বিপুল সংখ্যক হাসপাতাল ও হাসপাতালের বাইরে থাকা রোগী ও মৃত্যু হিসাব না থাকায় রোগ নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।

করোনা মহামারির সময় জরুরি উদ্যোগে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি স্থানীয় অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের তথ্যও মানুষ জানতে পারত। এবার ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে উল্টো চিত্র।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ৭০টি হাসপাতালে তথ্যে গত এক দিনে শনিবার রাত ৮টা পর্যন্ত রেকর্ড ২২৪২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। গত ২৩ বছরে এক দিনে এই বিপুল সংখ্যক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তথ্য দেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সব মিলিয়ে এ বছর হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৬৮৫ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ভর্তি হন ১৮ হাজার ৮৮৫ জন এবং ঢাকার বাইরে ১১ হাজার ৮০০ জন। শুধু জুলাইয়ের ২১ দিনেই ভর্তি হয়েছেন ২২ হাজার ৭০৭ জন।

এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও ১১ জন মারা গেছেন। তাতে এডিস মশাবাহিত রোগে এ বছর মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬৭ জনে। তাদের মধ্যে ১২০ জনের মৃত্যুই হয়েছে জুলাইয়ের প্রথম তিন সপ্তাহে।

জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিবন্ধিত সারাদেশে সরকার-বেসরকারি ৫ হাজার ২৭৫টি হাসপাতাল রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ২০টি সরকারি ও ৫০টি বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী তথ্য সরকারিভাবে দেওয়া হয়। এর বাইরে ৫ হাজার ২০৫টি হাসপাতাল রয়েছে। এমনকি অনেক রোগী আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছে, যার তথ্য নেই সরকারের কাছে। দেশে ৪২৪ উপজেলা, ৬৪ জেলা ও বিশেষায়িত পর্যায়ের মেডিকেল ৩০টিসহ মোট ৫৭৭ সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। এর মধ্যে ২০ হাসপাতালের তথ্য দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ৪ হাজার ৬৯৮টি বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে ৫০টি তথ্য আসছে।

রোগতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালে যে পরিমাণ রোগী থাকে এর অন্তত পাঁচগুণ বেশি পাওয়া যায় ওই এলাকায়। বৈজ্ঞানিক উপায়ে হাসপাতাল এলাকা অর্থাৎ ওই শহর বা গ্রামে জরিপ করলে দেখা যাবে, ১০ রোগী ভর্তি হলেও বাস্তবিক অর্থে চিকিৎসার বাইরে রয়েছে ৫০ জন। এ পদ্ধতিতে এনসেফালাইটিসের (জীবাণুঘটিত মস্তিষ্কের প্রদাহ) বেলায় জরিপ করা হয়েছিল।

কোনো রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর প্রকৃত চিত্র না এলে সঠিকভাবে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসার পদক্ষেপ নেওয়া যায় না বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। তিনি বলেন, আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হলে মানুষ আতঙ্কিত হবে এমন একটি ভুল ধারণা সরকারের রয়েছে। করোনার সময় সরকারের সম্মিলিত উদ্যোগে সব হাসপাতাল থেকে তথ্য নেওয়া সম্ভব হয়েছে। এখন সরকার বিশেষ নির্দেশনা দিলে এই তথ্য পাওয়া সম্ভব।

জনস্বাস্থ্যবিদ ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, দুর্বলতা ও সমালোচনার ভয়ে সংশ্লিষ্টরা ডেঙ্গুর প্রকৃত চিত্র সামনে আনতে চান না। ঢাকায় বহু বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি, সেখানে গুটি কয়েকের তথ্য পাচ্ছি আমরা। অধিদপ্তর দেখাতে চাচ্ছে না যে ডেঙ্গু মহামারি আকারে ছড়িয়েছে। মানুষ আতঙ্কিত হবে, বলবে সরকার তাহলে কী করে। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতেই তারা এটি করছে। আবু জামিল ফয়সাল বলেন, পুরো সিস্টেমেই গলদ। একটা ড্যাশবোর্ড থাকা দরকার ছিল, সেখানে সব প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তারা দিয়ে দিত। একই সঙ্গে কারা দিচ্ছে না, সেটিও বোঝা যেত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, সারাদেশের সব তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। গত এক সপ্তাহে নতুন করে ২০ হাসপাতাল যুক্ত করা হয়েছে। জেলার তথ্য নির্দিষ্ট সার্ভারে সংযুক্ত করলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সব একসঙ্গে প্রকাশ করে। তবে হাসপাতালের বাইরে থাকা রোগী ও মৃত্যুর হিসাব এখন যুক্ত করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, একযোগে তথ্য দেওয়ার জন্য এখনও সঠিক ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। তাই নির্দেশনা দিলেই সব তথ্য আসবে না। এখানে জনবল, অর্থ, প্রশিক্ষণ অনেক কিছু বিষয় রয়েছে। এগুলো চাইলেই এক দিনে ব্যস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে এগিয়ে নিচ্ছি।

এদিকে ঢাকাসহ সারাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি হলেও এখনও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক হেলথ ইমারজেন্সি বা জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা ঘোষণার সময় আসেনি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল দুপুরে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ঢাকাসহ ৬০ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। তবে এমন পরিস্থিতি এখনও হয়নি যে আমরা হাসপাতালে রোগীদের সিট দিতে পারছি না, ওষুধ দিতে পারছি না। এখনও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে।

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় যে ১১ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, তাদের মধ্যে ৯ জন মারা গেছেন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে, বাকি দুইজন ঢাকার বাইরে। বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৬৬৫৬ জন রোগী। তাদের মধ্যে ঢাকায় চিকিৎসাধীন ৩৮৩৯ জন এবং ঢাকার বাইরে ২৮১৭ জন।

এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে। জুনে যেখানে ৫ হাজার ৯৫৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, জুলাইয়ের প্রথম ২১ দিনেই সেই সংখ্যা বেড়ে সাড়ে তিনগুণ হয়েছে। আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত্যুও বেড়েছে। গত মাসে ৩৪ জনের মৃত্যু হলেও এ মাসের তিন সপ্তাহে প্রাণ গেছে ১২০ জনের।

এর আগে ২০১৯ সালে দেশের ৬৪ জেলায় এক লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ২৮১ জন মানুষ মারা যায় ২০২২ সালে। গত বছর সারাদেশে ৬২ হাজার ৩৮২ জন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

https://samakal.com/bangladesh/article/2307184964