২৩ জুলাই ২০২৩, রবিবার, ৩:৪০

দাম বাড়ানোর সুযোগ খুঁজছে মজুতদার

দেশে ধানের ফলন বাম্পার– সেই সূত্রে এবার চালের দাম কিছুটা কম থাকার কথা। তবে ভরা মৌসুমে বাজারে নেই সেই সুবাতাস। গেল বছর দাম যেখানে চড়েছিল, এবারও সেখানেই থিতু। এর মধ্যে চাল রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা বাজারের নতুন ‘বিপদ’। উৎপাদন ভালো হলেও বাংলাদেশকে প্রতিবছরই কমবেশি চাল আমদানি করতে হয়। এর সিংহভাগই জোগান দেয় প্রতিবেশী দেশটি। ভারতের নিষেধাজ্ঞার খবরে ইতোমধ্যে দেশের মিল মালিক ও বড় ব্যবসায়ীর কেউ কেউ কারসাজির পথ খুঁজছেন। তারা চাল মজুতের পথে হাঁটলে বাজারে দেখা দিতে পারে কৃত্রিম সংকট, যা চালের দামকে উস্কে দেবে। এরই মধ্যে বাজারে মোটা চাল কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ও সমকালের স্থানীয় প্রতিনিধিদের সহায়তায় এসব তথ্য মিলেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভারতের রপ্তানি বন্ধে দেশের চালের বাজারে প্রভাব পড়তে পারে। কারণ আগের বছরগুলোতে উৎপাদন ভালো হওয়ার পরও চাল আমদানি বেড়েছে। তাছাড়া এ সময় সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা চাল মজুত কারসাজির সুযোগ নিয়ে থাকে। কারসাজি ঠেকানো না গেলে বাজার নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে।

তবে মিলারদের দাবি, তারা চাল মজুত করছেন না। তাদের চালের হিসাব সরকারের কাছে রয়েছে। মূলত লাইসেন্সহীন চালের ব্যবসায়ীরা মজুত করে থাকেন।

সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করলেও দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়বে না। কারণ দেশে এবার বোরো উৎপাদন ভালো হয়েছে। আমনের ফলনও ভালো হবে। প্রায় একই মত আমদানিকারকদের। তারাও মনে করেন, ভারত থেকে চাল আমদানি না হলেও দেশের বাজারে খুব বেশি সমস্যা হবে না।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশের উৎপাদিত মোট ধানের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে বোরো থেকে। এবার বোরো উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ কোটি ১৫ লাখ টন। তবে চাল উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ১৮ লাখ টন। আমনের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ কোটি ৭২ লাখ টন।

মাস দুয়েকের মধ্যে আমনের ফলন উঠবে।
তবে উৎপাদন ভালো হলেও রাশিয়া-ইউক্রেনের উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে দানাদার খাদ্যশস্যের আন্তর্জাতিক বাজার। ইউক্রেনের বন্দর দিয়ে খাদ্যশস্য রপ্তানির চুক্তি নবায়ন করা থেকে সরে গেছে রাশিয়া। এতে বিশ্ববাজারে খাদ্য সংকটের পাশাপাশি দাম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন শঙ্কা তৈরি করেছে ভারতের নিষেধাজ্ঞা। আন্তর্জাতিক বাজারে চালের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ ভারত। এ বছর ভারতে ভারী বৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি এবং গত এক মাসে চালের দাম ৩ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার থেকে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেয় দেশটি।

বিশ্ববাজারে দাম ঊর্ধ্বমুখী
বিশ্বে চালের দাম এখন ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর কারণ, এল নিনোর প্রভাবে মূল উৎপাদকদের ফলন ব্যাহত হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের পূর্বাভাস হলো– ২০২৩ সালে বিশ্বের শীর্ষ ছয়টি চাল উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে রেকর্ড উৎপাদন হবে। ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশগুলোতে চালের দাম বাড়ছে। ভারতে দাম এ সপ্তাহে পাঁচ বছরের সর্বোচ্চ প্রতি টন ৪২১ থেকে ৪২৮ ডলারে পৌঁছায়। থাইল্যান্ডে প্রতি টনের দাম ৫৪৫ ডলার। ভিয়েতনামে প্রতি টনের দাম ৫১৫ থেকে ৫২৫ ডলারের মধ্যে, যা ২০১১ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়তে পারে। কারণ বাংলাদেশকে প্রতিবছর চাল আমদানি করতে হয়। প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় দাম ও পরিবহনে সাশ্রয়ের কারণে আমদানির সিংহভাগই হয় ভারত থেকে।

ভালো উৎপাদনেও বেড়েছে আমদানি

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানি হয়েছে ৯ লাখ ৮৮ হাজার টন। আর সদ্যসমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ১০ লাখ ৫৫ হাজার টন। সেই হিসাবে গত অর্থবছরে আমদানি বেড়েছে ৬৭ হাজার টন।

চালের বৃহত্তম বাজার নওগাঁ। উৎপাদনের পাশাপাশি সেখানে উত্তরাঞ্চলের অন্য জেলা থেকেও চাল আসে। তাছাড়া ভারত থেকেও বৈধ-অবৈধ পথে প্রচুর চাল ঢোকে নওগাঁ দিয়ে। ফলে চালের বাজারের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই এ অঞ্চলের মিলার ও ব্যবসায়ীদের হাতে। ভারতের চাল রপ্তানির নিষেধাজ্ঞার খবরে ইতোমধ্যে এ জেলার অনেক ব্যবসায়ী গোপনে গুদামে চাল মজুত করছেন। ধান উৎপাদনকারী অন্য জেলার মিলারও একই পথে হাঁটছেন। তবে নওগাঁয় চালের দাম বাড়লে সারাদেশে কমবেশি এর প্রভাব পড়ে।

বেড়েছে মোটা চালের দাম
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর টাউন হল ও মালিবাগ বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন-চার দিনের ব্যবধানে মোটা চাল (স্বর্ণা ও গুটি) কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে। এ মানের চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৪ টাকা দরে। চার দিন আগে এ দর ছিল ৪৮ থেকে ৫১ টাকা। তবে মাঝারি ও চিকন চালের দাম উচ্চদরে পৌঁছে স্থির রয়েছে। বাজারে মাঝারি আকারের (পাইজাম, লতা ও আটাশ জাতীয়) চালের কেজি ৫৫ থেকে ৫৮ এবং চিকন বা মিনিকেট চালের কেজি ৬৫ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ২ শতাংশ।

দেশের বাজারে পড়তে পারে প্রভাব
কারওয়ান বাজারের মতলব ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী রায়হান জগলু সমকালকে বলেন, পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার কারণে দেশে দাম হুহু করে বেড়েছিল। এখন আদা কম আসছে ভারত থেকে, এ কারণে আদার দাম বেশি। চাল রপ্তানি বন্ধ করলে দেশে অবশ্যই এর প্রভাব পড়বে।

দাম বাড়ানো-কমানোর চাবি মিলারদের হাতে থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা যখন শুনবে ভারত রপ্তানি বন্ধ করেছে, তখন দাম বাড়িয়ে দেবে। আবার যখন আমদানি হয়, তখন দ্রুত তাদের কাছে থাকা চাল কিছুটা ছাড় দিয়ে বাজারে ছেড়ে দেয়।

মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটের মোহাম্মদী চাল ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী নুরুল ইসলাম বলেন, ভারত থেকে কিছু চাল আমদানি হয়। তারা রপ্তানি বন্ধ করলে কিছু প্রভাব পড়বে। হয়তো এ সপ্তাহে চালের মোকামে দামে হেরফের হতে পারে।

ভারতের রপ্তানি বন্ধের কারণে দেশের চালের বাজারে প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, তিনটি বিষয় বিবেচনা করা যায়। প্রথমত, বৈশ্বিক বাজারে এর প্রভাব পড়বে। তবে অন্যতম রপ্তানিকারক থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের রপ্তানির পরিমাণের ওপর নির্ভর করবে বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে অবশ্যই প্রভাব পড়তে পারে। কারণ বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, ভালো ফলনের পরও আমদানি করতে হয়েছে। কারণ গম আমদানি কমার কারণে চালের বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। তৃতীয়ত, এ ধরনের পরিস্থিতিতে কিছু মিলার ও বড় ব্যবসায়ী কারসাজির সুযোগ নিয়ে থাকেন। সরকারের বাজার তদারকি পরিস্থিতি কতটা শক্ত হবে– এর ওপর নির্ভর করবে দামের স্থিতিশীলতা।

খাদ্যমন্ত্রী বলছেন, আমদানির দরকার নেই
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, এগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এবার চালের মজুত ভালো আছে। এরই মধ্যে অভ্যন্তরীণভাবে সাড়ে ৯ লাখ টন সংগ্রহ হয়েছে। আরও অনেক উৎপাদনকারী চাল দেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন।

ভারত বাসমতী ছাড়া অন্য সব ধরনের চাল রপ্তানি বন্ধ করেছে। তবে সেদ্ধ চাল রপ্তানি বন্ধ করেনি দাবি করে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ভারত আতপ চাল রপ্তানি বন্ধ করেছে। এ চাল আমদানি করতে হয় না। তবে সেদ্ধ চাল রপ্তানি বন্ধ করেনি। খাদ্যমন্ত্রী আরও বলেন, সম্প্রতি খাদ্যশস্য মজুত, পরিবহন ও বাজারজাতকরণ সংক্রান্ত আইন পাস হয়েছে। কেউ মজুত করলে কিংবা বাড়তি দাম নেওয়ার চেষ্টা করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নওগাঁয় চাল মজুতের অভিযোগ
বোরো মৌসুমে ধানের ফলন ভালো হলে নওগাঁর চালের বাজারে দাম কমে যায়। এটাই হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। এবার প্রত্যাশার চেয়েও বোরোর ভালো ফলন হয়েছে। তবু টানা এক মাস জেলার খুচরা ও পাইকারি বাজার এবং মিলগেটে চালের বাড়তি দাম দেখা গেছে। এর জন্য বড় মিলারদের সক্রিয় একটি সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন স্থানীয় খুচরা ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে রাশিয়ার শস্য চুক্তি বাতিল এবং ভারতের চাল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণায় অবৈধ সুযোগ নিতে মরিয়া নওগাঁর চালকল মালিকদের অনেকেই। তাদের কেউ কেউ নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত চাল মজুত করছেন।

নওগাঁ শহরের পৌর চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক উত্তম সরকার বলেন, বড় মিলারদের সিন্ডিকেটের কারণেই চালের বাজারে অস্থিরতা। সরেজমিন গিয়েও কয়েকটি গুদামে অতিরিক্ত চালের মজুত দেখা গেছে। নওগাঁ শহরের ঘোষ অটোমেটিক রাইস মিলে বস্তায় বস্তায় চালের মজুত দেখা গেছে। মিলটির স্বত্বাধিকারী দ্বিজেন ঘোষ বলেন, মিলে পুরোনো কোনো ধান-চাল মজুত নেই। অবৈধ মজুতের অভিযোগ ঠিক নয়।

দিনাজপুরের সব উপজেলায় মজুতদার
চাল উৎপাদনের অন্যতম উৎস দিনাজপুর। ভারতের রপ্তানি বন্ধের প্রভাব যেন না পড়ে সে জন্য মজুতদারদের নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি জানিয়েছেন ভোক্তারা। প্রতিটি উপজেলাতেই রয়েছে অবৈধ মজুতদার। তাদের মাধ্যমেই অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে ধান-চালের বাজার। বাংলাদেশ অটো ও মেজর হাসকিং মিল মালিক সমিতির সহসভাপতি শহীদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন বলেন, মিলাররা চাল মজুত করে না। কারণ মজুত করলে মিল চলবে কীভাবে? মিলাররা চাল বিক্রি না করলে তাদের ব্যাংক লোন, মিল খরচ, শ্রমিক খরচ সব মিলিয়ে লোকসান গুনতে হবে।

তিনি বলেন, মিল মালিকদের গুদামে চালের মজুতের হিসাব রয়েছে খাদ্য অফিসে। মূলত মজুত করে মিল মালিকদের বাইরের লোকজন। তারা কোনো লাইসেন্স না নিয়েই অবৈধভাবে মাত্রাতিরিক্ত মজুত করছে।
আটা-ময়দার বাজারে শঙ্কা

এদিকে রাশিয়া কৃষ্ণ সাগর শস্য চুক্তি বাতিল করার পর এ সপ্তাহে বিশ্বজুড়ে গমের দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ইউক্রেনীয় বন্দরে রুশ হামলার কারণে বিশ্বজুড়ে সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেওয়ায় শস্যটির দাম ১৬ মাসেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশেও আটার বাজার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী, এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ২ টাকা বেড়ে খোলা বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৪ টাকা দরে। আর প্যাকেটজাত আটা বিক্রি হচ্ছে ৫৭ থেকে ৬০ টাকা দরে। সপ্তাহখানেক আগে এ দর ছিল ৫৫ টাকার আশপাশে।
এ ব্যাপারে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ তো বছরের পর বছর লেগে থাকবে না, চুক্তিও আটকে থাকবে না। সমাধান হয়তো হবে। এ ছাড়া কানাডা ও আর্জেন্টিনা থেকে গম আমদানি করা যাবে। বেলারুশ, বুলগেরিয়া থেকেও গম আমদানির সুযোগ আছে।

https://samakal.com/economics/article/2307184965