২৩ জুলাই ২০২৩, রবিবার, ৩:৩৬

গতিতে বাড়ে ক্ষতি

দেশের গণপরিবহনগুলোতে চলছে গতির প্রতিযোগিতা। কে কার আগে যাবে সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় অকালে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। পঙ্গুত্ববরণ করে অন্যের বোঝা হয়ে পড়ে রয়েছেন আরও অনেকে। গণপরিবহনগুলোর এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে রেহাই পাচ্ছেনা কেউই। দিন দিন এই গতির প্রতিযোগিতায় বাড়ছে সড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা। মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেশের প্রধান মহাসড়কগুলো থেকে শুরু করে চলছে গ্রামীণ সড়কগুলোতেও। গণপরিবহনের পাশাপাশি গতির প্রতিযোগিতার অসুস্থ রোগে আক্রান্ত রাস্তায় চলাচলকারী মোটরসাইকেলগুলোও। এসব মোটরসাইকেল উঠতি বয়সের কিশোর ও যুবকদের হাতে চালানোর কারণে বেড়ে যায় গতির প্রতিযোগিতা। সড়ক ও মহাসড়কগুলোতে গতির প্রতিযোগিতা কমাতে না পারলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, গত জুনে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫৫৯টি। নিহত ৫১৬ জন ও আহত ৮১২ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে নারী ৭৮ ও শিশু ১১৪। গত মে মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে প্রতিদিন নিহত হয়েছিলেন ১৩ দশমিক ১৬ জন। জুনে গড়ে প্রতিদিন নিহত হয়েছেন ১৭ দশমিক ২ জন। এ হিসাবে জুনে প্রাণহানি বেড়েছে ৩০ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ২০৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১৬৯ জন, যা মোট নিহতের ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ৩৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ৯৯ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ১৯ দশমিক ১৮ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৭৬ জন, অর্থাৎ ১৪ দশমিক ৭২ শতাংশ।

দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী ১৬৯ জন, বাসযাত্রী ৭, ট্রাক-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি আরোহী ৬৫, প্রাইভেট কার-মাইক্রোবাস-অ্যাম্বুলেন্স-র‌্যাবের জিপ আরোহী ২৪, থ্রি হুইলার যাত্রী ১১৪, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী ২০ ও বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা-রিকশা ভ্যান আরোহী ১৮ জন। ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ১৬৮টি দুর্ঘটনায় ১০৯ জন নিহত। বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে কম ২৪টি দুর্ঘটনায় ১৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, বর্তমানে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে। অর্থাৎ অতিরিক্ত গতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এই গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না। গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণ যেমন দরকার, তেমনি দরকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন। যানবাহনে আধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্ত করতে হবে, যার মাধ্যমে গতিসীমা নজরদারি ও রেকর্ড করা যায়। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক হতে হবে।

এদিকে, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে চলতি বছরের জুন মাসে সারাদেশে ৪৭৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১৩ জন নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন আরও ৮২৬ জন। এই সময়ে ১৬০টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৭৬ জন নিহত, ১১৭ জন আহত হয়েছে। যা মোট দুর্ঘটনার ৩৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ, নিহতের ৩৭ দশমিক ০৫ শতাংশ ও আহতের ২৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। গত জুন মাসে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এই বিভাগে ১২৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১২৭ জন নিহত ও ২৬৩ জন আহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে বরিশাল বিভাগে। এই বিভাগে ২২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২১ জন নিহত ও ৫৮ জন আহত হয়েছেন। এতে দেখা যায়, ২৪ শতাংশ মোটরসাইকেল, ২৮ দশমিক ৭১ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান ও লরি, ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ বাস, ১৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক, ৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ নছিমন-করিমন-মাহিন্দ্রা-ট্রাক্টর ও লেগুনা, ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ কার-জিপ-মাইক্রোবাস সড়কে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। সংগঠিত মোট দুর্ঘটনার ৫৫.৭৮ শতাংশ গাড়িচাপা দেওয়ার ঘটনা, ২০ দশমিক ৬৩ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৪ দশমিক ৫২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে, ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ বিবিধ কারণে, ০ দশমিক ৮৪ শতাংশ গাড়ির চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে এবং ১ দশমিক ০৫ শতাংশ ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গত জুন মাসে সংগঠিত মোট দুর্ঘটনার ৩৩ দশমিক ২৬ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৩২ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে। এ ছাড়াও সারা দেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ০ দশমিক ৬৩ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে ও ১ দশমিক ০৫ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে সংগঠিত হয়েছে বলেও সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

সড়ক ও জনপদ অধিদফরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তানভীর সিদ্দিকী বলেন, বিভিন্ন সংস্থা ভিন্ন ভিন্ন দুর্ঘটনার তথ্য দেয়। আসলে আমাদের কাছে প্রোপার ডাটা নেই। যার ফলে আমরা কাজ করতে পারি না। দুর্ঘটনার প্রোপার ডাটা তৈরি করা উচিত।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ভৌগোলিক অবস্থা বুঝে আমাদের যানবাহনের গতিসীমা নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের কোনো এক সড়কে গতিসীমা দিয়ে রাখলাম ৮০ কি.মি., কিন্তু বন্যার সময় সেখানে সে গতিতে চলা সম্ভব না। সেক্ষেত্রে সেখানে ভেরিয়েবল সাইনবোর্ড থাকা জরুরি। স্কুল পর্যায় থেকে আমাদের সচেতনতা তৈরি করতে হবে। আর কোনো গতিসীমা নির্ধারণ বা নিয়মনীতি করলে তা যেন চালকরা জানতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেছেন, গাড়ির স্পিড কমানো গেলে দুর্ঘটনা কমে যাবে। এজন্য আমরা একটা গাইডলাইন তৈরির কাজ করছি। দ্রুতই একটি স্পিড নীতিমালা করা হবে। আমরা একটা প্রস্তাবনা করেছিলাম যেখানে শহরের মধ্যে যানবাহনের স্পিড ৩০ কিমি. (ঘণ্টা) করা প্রয়োজন। যখনই একটা যানবাহনের জন্য আমাদের শহরে বলা হলো ৩০ কিলোমিটার করা হবে, তারপরের দিনই মানববন্ধন করে বলা হলো যে, এই গতিসীমা বাড়াতে হবে। এটাই হচ্ছে আমাদের বর্তমান বাস্তব অবস্থা।

তিনি বলেন, হাইওয়েগুলোতে গতিসীমা ৮০ করা হয়েছে। কেউ বলছেন, হাইওয়েতে ৮০ কিলোমিটার বেগে চালানো যায়, এই গতিসীমা ১০০ করে দিন। কিন্তু আমি এসবের পক্ষে নই। যেখানে স্পিড বাড়বে সেখানে দুর্ঘটনা বাড়বে। তাই গতিসীমা কমানো উচিত।

https://dailyinqilab.com/national/article/589390