২২ জুলাই ২০২৩, শনিবার, ১২:৩১

ভিন্ন স্তরের সরকারি চাকরিজীবী

ভোটের আগে অঢেল সুবিধা

আওয়ামী লীগ সরকারের টানা সাড়ে ১৪ বছরে অঢেল সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন বিভিন্ন স্তরের চাকরিজীবীরা। বিশেষ করে গত দুটি (২০১৪ ও ২০১৮) নির্বাচনের আগে এবং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এগুলো দেওয়া হয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনি কাজে সরাসরি যুক্ত থাকেন প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও শিক্ষকসহ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। তাদের সন্তুষ্ট রাখতেই মূলত এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে কর্মরত সরকারি চাকরিজীবীরা মনে করছেন-পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধিসহ অন্যান্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে নির্বাচন কিংবা অন্য কিছুর সম্পর্ক নেই। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে সরকারের উচিত ছিল তাদের বেতন-ভাতা আরও আগেই বৃদ্ধি করা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উল্লিখিত সময়ে যেসব সুযোগ-সুবিধা সরকারি চাকরিজীবীদের দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-প্রশাসনে সিনিয়র সচিবের পদ সৃজন। সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেওয়া হয়েছে ৫ শতাংশ সুদে গৃহঋণ। প্রশাসন ক্যাডারের উপসচিব ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তা এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের যুগ্মসচিব (ড্রাফটিং) থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তারা সুদমুক্ত ৩০ লাখ টাকা ঋণে গাড়ি ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ মাসে ৫০ হাজার টাকা পাচ্ছেন।

শুধু তাই নয়, চলমান অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও ১৮ জুলাই অর্থ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনে সরকারি চাকরিজীবীদের ৫ শতাংশ বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। তবে যাদের বেতন কম তাদের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১ হাজার টাকা প্রণোদনা দেওয়া হয়। সর্বশেষ বুধবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক প্রজ্ঞাপনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, বোনাস ও উৎসব ভাতা করের আওতামুক্ত করে আদেশ জারি করেছে। তবে অন্যান্য আয়ের ওপর কর দিতে হবে।

যেমন সেমিনারের সম্মানি, মিটিং ভাতা, মডারেটর ভাতা, প্রবন্ধ উপস্থাপন ভাতা, প্রেজেন্টার ভাতা ইত্যাদির ওপর কর থাকবে। এছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে করা ফৌজদারি মামলায় আদালতে চার্জশিট গৃহীত হওয়ার আগে গ্রেফতারে সরকারের পূর্বানুমতি নিতে হবে-এমন বিধান রেখে পাশ করা হয়েছে বিদ্যমান আইনের সংশোধনী। অন্যদিকে পুলিশ সার্ভিসের শীর্ষপদটি সিনিয়ন সচিব এবং আরও পাঁচটি পদ সচিব পদমর্যাদা দেওয়া হয়। পুলিশের পরিদর্শকরা পেয়েছেন প্রথম শ্রেণির মর্যাদা।

বিশ্লেষকদের অভিমত-সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীর আলোকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি শরিকদের নিয়ে হয়তো কঠোর আন্দোলনে যাবে। জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন সরকারের পক্ষে না থাকলে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা খুশি থাকলে সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। এসব কারণ বিবেচনা করেই সব পক্ষকে খুশি রাখতে চাচ্ছে সরকার। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। এরপর ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে উল্লিখিত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া শুরু হয়।
জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, যত সুযোগ-সুবিধাই দেওয়া হোক যদি প্রকৃত অর্থে অংশগ্রহণমূলক সত্যিকারের নির্বাচন হয়, তাহলে এসব সুযোগ-সুবিধা কোনো কাজে আসবে না। আর যদি ২০১৪ এবং ২০১৮ স্টাইলে নির্বাচন হয়, তখন কর্মচারীদের ব্যবহার করা যাবে। তিনি আরও বলেন, অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার দরকার ছিল না। নামমাত্র সুদে গৃহঋণ দেওয়া অপ্রয়োজনীয় ছিল। সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি কেনার সুযোগ দেওয়ায় অর্থের অপচয় হয়েছে। তবে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল। তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে ফৌজদারি অপরাধে গ্রেফতারের আগে সরকারের অনুমতি নেওয়াসংক্রান্ত আইন করার দরকার ছিল না। বিষয়টি ফৌজদারি কার্যবিধির বিধানমতে নিষ্পত্তি হলেই ভালো হতো।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, সরকার যখন প্রশাসন নির্ভর হয়ে যায় তখন সরকার কর্মচারীদের হাতে রাখতে তৎপর হয়ে উঠে। সরকারের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক যত কমবে, সরকার তত প্রশাসন নির্ভর হয়ে পড়বে। এখানে এমন অনেক বিষয় রয়েছে। আর পদোন্নতি দিতেই পারে। বাড়তি সুযোগ হিসাবে সিনিয়র সচিবের পদ সৃজন করা হয়েছে। এসব করে সরকার টিকে থাকার চেষ্টা করেছে মাত্র। প্রশাসন থেকে বাড়তি সুবিধা পেতে চাচ্ছে বলে মনে হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বাস্তবায়ন) আবদুর রহমান খান যুগান্তরকে বলেন, কর্মচারীদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্রের কল্যাণে দেওয়া হয়। কর্মচারীরা রাষ্ট্রের জন্য কাজ করেন। তার সচ্ছল না থাকলে কাজ করবেন কি করে। অনেক কর্মকর্তা আছেন সৎভাবে জীবনযাপন করতে চান। কম সুদে ঋণ নিয়ে বসবাসের একটা জায়গা করতে পারলে তো তিনি অসৎ পথে পা বাড়াবেন না। সরকার কর্মচারীদের অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো সুবিধা দেয়নি। বরং বর্তমান সময়ে কর্মচারীরা আরও সুবিধা পেলে তা রাষ্ট্রের কল্যাণ হতো। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারতেন।

তিনি আরও বলেন, সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি ক্রয় করে কর্মকর্তারা সেই গাড়ি রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার করেন। সুতরাং এসব সুবিধা কর্মকর্তাদের চেয়ে রাষ্ট্রের কাজে বেশি ব্যবহৃত হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের অসৎ বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এসব সুবিধা দেওয়ার দাবি অবান্তর। বরং আরও সুবিধা দিলে রাষ্ট্র উপকৃত হতো।

জানা গেছে, বিগত সাড়ে ১৪ বছরে সরকারি কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ পদোন্নতি পেয়েছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিগত সাড়ে ১৪ বছরে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে সাড়ে তিন হাজার কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। সহকারী সচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত এসব পদোন্নতি বিভিন্ন সময়ে দেওয়া হয়। প্রশাসনে ২০১২ সালে সৃজন করা হয় সিনিয়র সচিবের পদ। সচিব এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঝামাঝি একটি মর্যাদাপূর্ণ পদ হচ্ছে সিনিয়র সচিব।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ২০১৮ সাল থেকে ৫ শতাংশ সুদে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকার গৃহঋণ সুবিধা পাচ্ছেন। গৃহঋণের প্রজ্ঞাপন অনুসারে, জাতীয় বেতন স্কেলের গ্রেডভেদে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ এবং সর্বনিু ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন একজন সরকারি চাকরিজীবী। এ ঋণের মোট সুদহার ১০ শতাংশ হবে। তবে এ ১০ শতাংশ সুদের ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসাবে প্রদান করবে এবং বাকি ৫ শতাংশ ঋণগ্রহীতা পরিশোধ করবে। ৬ মাস (ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে) থেকে ১ বছরের (বাড়ি নির্মাণ) গ্রেস পিরিয়ডসহ (এই সময়ের মধ্যে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না) ২০ বছর মেয়াদে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সরকারের প্রায় ১২ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী গৃহনির্মাণ ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন। তারা এককভাবে এ ঋণ নিতে পারবেন। এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী এ ঋণ দেওয়া হয়।

বিসিএস পুলিশ সার্ভিসের শীর্ষ পদটি সিনিয়র সচিবের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (প্রশাসন ও অপারেশন), অতিরিক্ত আইজি (এসবি), র‌্যাবের মহাপরিচালক, ডিএমপি কমিশনার এবং সারদা পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপালের পদটি গ্রেড-১ ভুক্ত করা হয়েছে। পুলিশের পরিদর্শক পদটি প্রথম শ্রেণি এবং উপপরিদর্শক পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদায় উন্নীত করা হয়েছে। ১৮ জুলাই অর্থ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য ৫ শতাংশ বিশেষ সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ২১৭টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় নয় হাজার শিক্ষককে তৃতীয় শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়েছে। এছাড়া ২৮৩ কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, যে কোনো সরকার তাদেরকেই বেশি সুযোগ-সুবিধা দেবে, যারা সরকারের জন্য উপকারী কাজ করতে পারবে। সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় উপকার হবে আগামী নির্বাচনে সরকারকে জয়ী হতে সহায়তা করা। আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও শিক্ষকদের মাধ্যমেই তো নির্বাচন পরিচালনা করা হবে। নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্তদের সুযোগ-সুবিধা আরও বৃদ্ধি করা হবে। অতীতের ধারাবাহিকতায় আগামী ৩ মাসে তাদের আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।

নির্বাচনের আগে তাদের নববর্ষের বোনাস দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফৌজদারি মামলায় চার্জশিট হওয়ার আগে গ্রেফতারে সরকারের পূর্বানুমতি নিতে আইন সংশোধন প্রসঙ্গে শাহদীন মালিক বলেন, এটি বাংলাদেশের সংবিধানের পরিপন্থি যা এককথায় বৈষম্যমূলক। যা এক কথায় এক দেশে দুই ধরনের আইন থাকতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, মোটকথা নির্বাচনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল নিশ্চিত করতে পারবে। এক কথায় নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ ও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল নিশ্চিত করার জন্য সরকার তাদের উল্লিখ সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, সরকারের দুই ধরনের দায়বদ্ধতা থাকে। এক হচ্ছে জনগণের কাছে, মুখোমুখি দায়বদ্ধতা। প্রতি ৫ বছর অন্তর জনগণের কাছে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভোট প্রার্থনা করা। সরকারের যখন জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা থাকে, তখন তাদের স্বার্থে, তাদের কল্যাণে কাজ করতে হয়। তাদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করতে হয়। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের কাছে দায়বদ্ধতা, যা সংসদ, আদালত ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারকে জবাবদিহি করতে হয়। বর্তমান সংসদ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নয়। কারণ বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে তারা নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতিষ্ঠানগুলোও দলীয়করণ করা হয়েছে। সরকারের এ দুটি জায়গার একটিতেও দায়বদ্ধতা নেই। ফলে সরকারকে কারও কাছে জবাবদিহিতা করতে হয় না। সরকারের একমাত্র দায়বদ্ধতা হচ্ছে তাদের কাছে যারা তাদের ক্ষমতায় এনেছে এবং টিকিয়ে রেখেছে। তাদের খুশি রাখা এবং সুবিধা দেওয়া সরকারের কাজে পরিণত হয়েছে। সরকার আমলা, পুলিশ, শিক্ষকসহ সবাইকে সুবিধা দিয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে চাচ্ছে। সে কারণেই সরকার ধারাবাহিক ভাবে তাদের সুযোগ দিয়ে সন্তুষ্ট রাখছে। আরও সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/698555