২১ জুলাই ২০২৩, শুক্রবার, ৬:২২

বছরজুড়েই থাকবে সংক্রমণ, ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি ১৭৫৫

ডেঙ্গুর বাহক এডিশ মশা
এডিস মশা পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে শিখেছে। আগে বলা হতো ডেঙ্গু রাজধানীকেন্দ্রিক রোগ। এখন সারা দেশেই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যত রোগী (১,৭৫৫ জন) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তার বেশিরভাগই ঢাকার বাইরের। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এ বছরই প্রথম ঢাকার চেয়ে বাইরের রোগী বেশি দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশা দেশের প্রতিকূল জলবায়ুর সঙ্গে টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করতে শুরু করছে। এমনকি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যে রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে তাও প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। ফলে এখন আর শুধু বর্ষাকাল নয়, বরং বছরজুড়েই ডেঙ্গুর সংক্রমণ থাকবে। ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে সারা বছর মশক নিধনসহ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে মোট ১৭৫৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে মারা গেছেন ৯ জন। এদের মধ্যে ৮ জন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে এবং একজনের মৃত্যু ঢাকার বাইরে। ডেঙ্গুতে এ বছর মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫৫ জনে। এর মধ্যে চলতি জুলাই মাসের ১৯ দিনে মারা গেছেন ১০৮ জন। ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তদের মধ্যে ৯১০ জন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ঢাকায় ভর্তি হয়েছে ৮৪৫ জন। এ বছর হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে ২৭ হাজার ৫৪৭ জন। শুধু জুলাই মাসের ১৯ দিনেই ভর্তি হয়েছেন ১৯ হাজার ৫৬৯ জন। বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৫ হাজার ৯৩৭ জন রোগী। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৩৫২২ জন এবং ঢাকার বাইরে ২৪১৫ জন।

বছরজুড়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি থাকার ইঙ্গিত দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ১৫৫। অথচ আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু ভয়াবহ আকারে বাড়তে পারে। তখন পরিস্থিতি কী হবে তা ভাবতে ভয় হচ্ছে। জুন মাসে ৫৯৫৬ রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সময় মৃত্যু হয়েছিল ৩৪ জনের। জুলাইয়ের প্রথম ১৯ দিনেই সেই সংখ্যা বেড়ে তিনগুণ হয়েছে।

মাসের হিসাবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন, মে মাসে ১০৩৬ জন এবং জুন মাসে ৫৯৫৬ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে জানুয়ারিতে ছয়জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন, এপ্রিলে দুজন, মে মাসে দুজন এবং জুন মাসে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।

জানতে চাইলে সরকারের জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার যুগান্তরকে বলেন, ডেঙ্গুতে ২০২১ সালে মোট ১০৫ জন মারা গিয়েছিল। সেখানে গত বছরের নভেম্বর অর্থাৎ এক মাসেই ডেঙ্গুতে ১১৩ জন মারা যান। বলা হয়, বৃষ্টিপাত না হলে এবং তাপমাত্রা কম থাকলে এডিস মশা কমে যায়। কিন্তু এখন বৃষ্টি ও তাপমাত্রা কোনোটাই নিয়ম মেনে হচ্ছে না। এডিস মশার প্রাদুর্ভাব মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেখা দেওয়ার সময়কাল হলেও গত বছরের নভেম্বর মাসে ডেঙ্গুর সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল। গত দুই বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার ও যত রোগী পাওয়া গেছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে এবারও বছরের শেষদিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি থেকে সহজেই বলা যায়, ডেঙ্গু আর বর্ষাকালে সীমাবদ্ধ নেই। বছরজুড়ে ডেঙ্গু সংক্রমণ থাকবে।

বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে আরও বলেন, দেশে এর আগে সর্বোচ্চ সংক্রমণের বছর ২০১৯ সালে প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিল ২২০৮ জন। গত বছরের প্রথম ছয় মাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১০৮৯ জন। কিন্তু এ বছরের জুন মাস পর্যন্ত ৭৭৫৪ জন। গত বছরের জুন পর্যন্ত এ রোগে মারা যান মাত্র একজন। অন্যদিকে এ বছর এডিস মশা শনাক্তে চালানো জরিপে ঢাকায় মশার যে উপস্থিতি দেখা গেছে, তা ঝুঁকিপূর্ণ। এ অবস্থায় সামনে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।

তাদের দাবি এডিস মশার দুই প্রজাতির মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়ায়। এরা এডিস এজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটস। বিগত দুই দশকের বেশি সময় ধরে এডিস মশা ও এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ইয়ালো ফিভার, জিকা ভাইরাসসহ অনেক রোগ মানুষকে আক্রান্ত করছে। অনেকের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। কিন্তু এই মশা বা অন্য পোকামাকড়বাহিত রোগ নিয়ে দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে তেমন কাজ হচ্ছে না। এডিসের বাইরে অন্য কোনো প্রজাতি এই ভাইরাস বহন করছে কিনা তা নিয়েও গবেষণা হচ্ছে না। দিন যত যাচ্ছে পরিবেশের দূষণ বা পরিবর্তনের ফলে অথবা উপর্যুপরি কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মশার শরীরবৃত্তীয় কার্যক্রমের পরিবর্তন ঘটিয়ে আরও প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। সারা বছর মানুষকে আক্রান্ত করছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল যুগান্তরকে বলেন, এখন শীতকালেও ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। বলা হতো এডিস ইজিপ্ট মশা, বাড়িঘরের আঙিনায় বেশি থাকে, যেটি ডেঙ্গু ছড়ায়। ২০১৯ সালের পর থেকে অন্য ধরনের এডিস মশাও ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। এডিসের আরেকটি প্রজাতি ঝোপঝাড়ে, গাছের বড় পাতায় জমা পানিতে থাকে। ফলে আবাসিক ধরনের মশা ছাড়াও বন্য ধরনের মশাও এখন ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। বিবর্তনের মাধ্যমে মশা সুপার পতঙ্গে পরিণত হচ্ছে। তাই মশার আচরণ এবং মশা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হওয়া দরকার। এডিস মশা যেখানে বংশবিস্তার করে, সেগুলো ধ্বংস করতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক মশার লার্ভা বা শুক্রকীটগুলোকে মেরে ফেলা ও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত চিকিৎসা করতে হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/698206