২১ জুলাই ২০২৩, শুক্রবার, ৬:১৫

সুন্দরবনে চলছে হরিণ শিকারের মহোৎসব

 সুন্দরবনে চলছে হরিণ শিকারের মহোৎসব। অসাধু বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে এসব হরিণ শিকার করছে পাচারকারীরা। এতে একদিকে যেমন সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ হরিণ অস্তিত্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ হওয়ায় বনের ইকো সিস্টেম নষ্ট হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সুন্দরবনের হরিণসহ সকল বন্য সম্পদ রক্ষায় আরও কঠোরভাবে নজরদারি বাড়াতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আবারও খুলনার কয়রা থেকে হরিণের ৫৩ কেজি গোশত উদ্ধার করেছে পুলিশ। বুধবার ভোরে উপজেলার ৪নং কয়রায় শাকবারিয়া খালের পাশে অভিযান চালিয়ে এ গোশত উদ্ধার করা হয়। খালে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যায় পাচারকারীরা।

উপজেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য মতে, সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়রা উপজেলায় হরিণ শিকারিদের দৌরাত্ম্য সব চেয়ে বেশি। গত তিন মাসে এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫৩২ কেজি হরিণের গোশত, একটি গলাকাটা হরিণ, পাঁচটি চামড়া ও মাথা জব্দ করে প্রশাসন। এ সময় মামলা হয়েছে ১০টি, গ্রেফতার হয়েছেন ৬ জন। গত এক বছরে এক সংখ্যা ৫০ জনের বেশি। স¤প্রতি তিন মণ হরিণের গোশতসহ এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ অবস্থার মধ্যে গত ২৫ এপ্রিল কয়রা উপজেলা পরিষদের সম্মেলন কক্ষে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় নির্বিচারে হরিণ নিধনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ পায়।

জানা যায়, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই চিত্রা হরিণ। কিন্তু দিনের পর দিন প্রশাসনের রেড এলাডসহ বিভিন্ন অভিযানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হরিণ নিধন করে যাচ্ছে পাচারকারীরা।

স্থানীয়রা বলছে, সুন্দরবনসংলগ্ন উপজেলা ও আশপাশের এলাকায় দাম কম হওয়ায় এই বন্যপ্রাণীর গোশতের চাহিদা বেড়েছে। এ সুযোগে গত কয়েক মাস ধরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চোরাশিকারিরা। বিভিন্ন উৎসব-পার্বনে এসব চোরাশিকারিদের দৌরাত্ম আরও বেড়ে যায়।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় কয়েকটি চক্র অনেক আগে থেকেই হরিণ শিকারের সঙ্গে জড়িত। বনবিভাগের কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে অগ্রিম ‘দাদন’ নিয়ে জেলের ছদ্মবেশে মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে বনে ঢুকে চোরা শিকারিরা। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে ‘এজেন্ট ব্যবসায়ীদের’। এই এজেন্টদের মাধ্যমে কখনও অগ্রিম, আবার কখনও গোশত এনেও বিক্রি করা হয়। এই চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানেও পৌঁছে যায় হরিণের গোশত।

সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, “বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ হলেও আইন অমান্য করে সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ চিত্রা হরিণ শিকার করছে কয়েকটি চক্র। যে পরিমাণ হরিণের গোশতও চামড়া জব্দ হয়, তার থেকে কয়েকগুণ বেশি হরিণ শিকার হয়।

অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির আরও বলেন “মাঝে-মধ্যে দু-একটি অভিযানে হরিণের গোশত, চামড়া, মাথা জব্দ হলেও মূল চোরাশিকারি ও পাচারকারীরা থেকে যান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গোশত বহনকারীরাই ধরা পড়ে। তারা দুর্বল আইনের কারণে কয়েক দিন পর জেল থেকে ফিরে একই কাজে লিপ্ত হন।

তিনি আরও বলেন, বনে বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ। সুন্দরবনের ইকো সিস্টেমের ভারসাম্য রাখতে সব প্রাণীরই প্রয়োজন। কোনো একটি না থাকলে সিস্টেম নষ্ট হয়ে যায়।

কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের বাসিন্দা সোলায়মান গাজী বলেন, সুন্দরবন প্রভাবিত কয়রার গ্রামগুলোতে বেশির ভাগই শ্রমজীবী মানুষের বসবাস। এসব গ্রামের প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ সুন্দরবন কেন্দ্রিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ উপজেলার ৩০টির বেশি চোরাশিকারি চক্র নির্বিচারে সুন্দরবনের হরিণ নিধন করছে।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মমিনুর রহমান বলেন, সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়রায় সুন্দরবন কেন্দ্রিক অপরাধ প্রবণতার চিত্র তাদের উদ্বিগ্ন করেছে। তিনি আরও বলেন, বিশেষত হরিণ শিকারিদের দৌরাত্ম রুখতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বন বিভাগকে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।

সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, অল্প জনবল দিয়ে এত বড় বনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হয় বনবিভাগের। তারপরও হরিণ শিকার আগের তুলনায় অনেকাংশে কমেছে। র‌্যাব, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও বনবিভাগের নিয়মিত টহলের কারণে এখন বনে হরিণ শিকারের সুযোগ কম। মোহসিন বলেন, বনে জলদস্যুরাই বেশি হরিণ শিকার করে খেত। ২০১৮ সালে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হওয়ায় পর এবং গত কয়েক বছর রাসমেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বনে হরিণ শিকার কমেছে।
তাছাড়া স¤প্রতিক বন্যপ্রাণী রক্ষায় অপরাধে জড়িতদের তথ্য প্রদানকারীকে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণার ফলে চোরাশিকারিদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ তথ্য দিতে উৎসাহিত হয়েছে। এখন গোশতসহ হরিণ শিকারি বেশি ধরা পড়ছে।

https://dailysangram.info/post/530468