২৭ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৩০

অতিরিক্ত মূল্যে চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়

শতকোটি টাকা লুটের শঙ্কা

প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনার তালিকায় আছে এসপিওয়াই ইন্ট্রাঅপারেটিভ ইমেজিং সিস্টেম নামের ১৪টি সার্জিক্যাল মেশিন। এ মুহূর্তে দেশে এসব মেশিন ব্যবহারের কোনো সুযোগ বা প্রয়োজনীয়তা নেই - অভিমত বিশেষজ্ঞদের

প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনার তালিকায় আছে এসপিওয়াই ইন্ট্রাঅপারেটিভ ইমেজিং সিস্টেম নামের ১৪টি সার্জিক্যাল মেশিন। এ মুহূর্তে দেশে এসব মেশিন ব্যবহারের কোনো সুযোগ বা প্রয়োজনীয়তা নেই - অভিমত বিশেষজ্ঞদের
দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের জন্য অতিরিক্ত মূল্যে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এতে শতকোটি টাকা সরকারের গচ্চা যাবে। যার পুরোটাই লুটপাট হবে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। শুধু তাই নয়, এসব সরঞ্জামের অনেকই এ মুহূর্তে তেমন কোনো প্রয়োজন নেই বলেও মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।


সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের তালিকা স্বাস্থ্য অধিদফতরে পাঠানো হয়েছে। এগুলো সমন্বয় করে একটি তালিকা তৈরি করেছে অধিদফতরের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরেস ডিপার্টমেন্ট (সিএমএসডি)। এ তালিকায় প্রত্যেকটি যন্ত্রের দাম প্রকৃত দামের চেয়ে অনেক বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। এ তালিকায় ২৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ ধরনের ৮৪টি মেশিন কেনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৯টি মেশিনেই অতিরিক্ত দাম ধরা হয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় শতকোটি টাকা। সরঞ্জাম ক্রয়ের তালিকাটি অধিদফতর হয়ে এ মুহূর্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম ১৭ এপ্রিল টেলিফোনে যুগান্তরকে জানান, বিষয়টি এখনও তার নজরে আসেনি। তালিকাটি খতিয়ে দেখা হবে। যদি সরঞ্জাম ক্রয়ে অতিরিক্ত মূল্য দেখানো হয়, তবে অবশ্যই এ হরিলুট বন্ধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তালিকায় দেখা গেছে, এসপিওয়াই ইন্ট্রাঅপারেটিভ ইমেজিং সিস্টেম নামে একটি সার্জিক্যাল মেশিনের ১৪টি ইউনিট ক্রয়ের কথা বলা আছে। এ মেশিনের প্রতিটির দাম ধরা হয়েছে সাড়ে ৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ১৪টির মোট দাম হচ্ছে ৯১ কোটি টাকা। চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এ মেশিনের সর্বোচ্চ মূল্য আড়াই কোটি টাকা। মেশিনপ্রতি অতিরিক্ত মূল্য দেখানো হয়েছে ৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ ১৪টি মেশিন ক্রয়ে সরকারকে গচ্চা দিতে হবে ৫৬ কোটি টাকা।

এ মেশিনের দাম সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধানে গেলে দুটি ইমেইল যুগান্তরের হাতে আসে। সেখানে দেখা গেছে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কানডার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে মেশিনের দাম সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। ওই কোম্পানির ইমেইল উত্তরে বলা হয়েছে, এক বছরের ওয়ারেন্টিসহ একটি মেশিনের দাম ধরা হয়েছে আড়াই লাখ ডলার। কিন্তু বাংলাদেশে বিক্রির ক্ষেত্রে মেশিনের ওয়ারেন্টি দেয়া হবে ৩ বছর। পাশাপাশি প্রতি মেশিনের জন্য দুইজন চিকিৎসককে বিদেশে প্রশিক্ষণ বাবদ ৫০ ভাগ ব্যয় নির্বাহ করা হবে। এটি অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিটি মেশিনের মোট দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ১০ হাজার ডলার। অর্থাৎ প্রতি ডলার ৮০ টাকা ধরলে একটি মেশিনের দাম আসে ২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। সেই হিসাবে ১৪টি মেশিনের দাম আসে ৩৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। কিন্তু সিএমএসডি’র তৈরি করা তালিকায় ১৪টি মেশিনের মোট দাম দেখানো হয়েছে ৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ অতিরিক্ত মূল্য দেখানো হয়েছে ৫৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা।

এ মেশিনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি মেডিকেল কলেজের একজন অধ্যাপক (সার্জন) বলেন, জেনারেল সার্জারিতে এ মেশিনের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। তবে প্লাস্টিক সার্জনদের চিকিৎসায় এর কিছু উপযোগিতা রয়েছে। এটি একটি সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। তবে বাংলাদেশে এর ব্যবহার নেই বললেই চলে। এমনকি ভারতেও দিল্লির দু-একটি হাসপাতাল ছাড়া এ মেশিনের ব্যবহার নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্মাণাধীন শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের জাতীয় সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন এসপিওয়াই মেশিন ক্রয়ের একটি প্রস্তাব দেন। সেই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতেই সিএমএসডির ওই তালিকায় এ মেশিনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. সামন্ত লাল সেন যুগান্তরকে বলেন, নির্মাণাধীন শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের জন্য তিনি একটি এসপিওয়াই মেশিন কেনার কথা ভেবেছিলেন। তবে সেটা এখনই নয়। মেশিনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি বলেন, উন্নত দেশে জটিল প্লাস্টিক সার্জারি অ্যান্ড রি-কনস্ট্রাকটিভ সার্জারিতে এ মেশিন ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে এ মেশিন ব্যবহারের কোনো উপযোগিতা বর্তমানে নেই বললেই চলে। কারণ দেশে এ মেশিন চালানোর ওপর কোনো প্রশিক্ষণ কারও নেই। ১৪টি মেশিন কেনার প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি জানান, তিনি ভবিষ্যতের জন্য একটি মেশিন কেনার কথা বলেছিলেন, ১৪টি নয়। তাছাড়া বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ডিএমসিএইচ) বার্ন ইউনিট ছাড়া দেশের অন্য কোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ ধরনের মেশিন ব্যবহারের কোনো সুযোগ বা প্রয়োজনীয়তাও নেই।

১৪টি এসপিওয়াই সার্জিক্যাল মেশিন ছাড়া ক্রয় তালিকায় যেসব সরঞ্জাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ১২৮ স্লাইসের ২টি সিটি স্কান মেশিন ক্রয়, যার মূল্য দেখানো হয়েছে ৬ কোটি ৫৬ লাখ ৯৯ হাজার ৯০০ টাকা। বিভিন্ন আমদানিকারক ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড আধুনিক মেশিনের ভ্যাট, ট্যাক্স, মুনাফাসহ দাম পড়ে সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ দুটি মেশিনে অতিরিক্ত ৩ কোটি টাকা মূল্য ধরা হয়েছে। আর যদি এক্ষেত্রে চায়না মেশিন ক্রয় করা হয়, সেক্ষেত্রে এ মেশিনের দাম আরও কমে যাবে। তালিকায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টসহ হেমোডায়ালাইসিস মেশিনের দাম দেখানো হয়েছে ২০ লাখ ৪১ হাজার টাকা। ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড মেশিন কিনলে ভ্যাট-ট্যাক্স-কাস্টমস ও মুনাফাসহ দাম পড়ে ১৫ থেকে ১৬ লাখ টাকা। সেক্ষেত্রে প্রতিটি মেশিনে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত দাম দেখানো হয়েছে। এই মেশিন ২০টি কেনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ডায়ালাইসিস মেশিন ক্রয়ে ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা অতিরিক্ত মূল্য দেখানো হয়েছে।

এছাড়া দুটি লেজার কন্ট্রোল সার্জারি সিস্টেম কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। যার প্রতিটির দাম দেখানো হয়েছে ১৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এ দুটির দাম ২৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ ধরনের একটি মেশিনের বাজারমূল্য সর্বোচ্চ ৯ কোটি টাকার মধ্যে। অর্থাৎ দুটি মেশিনে অতিরিক্ত দাম ধরা হয়েছে প্রায় ৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। তালিকায় আরও আছে দুটি লেজার এন্ডোস্কপি মেশিন। এর একেকটির দাম দেখানো হয়েছে ৯ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টদের মতে ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড দুটি মেশিনের দাম সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ দুটি মেশিনে অতিরিক্ত দাম ধরা হয়েছে ৪ কোটি টাকা। আর একটি নিউরো নেভিগেশন সিস্টেম মেশিনের জন্য দাম ধরা হয়েছে ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর সর্বোচ্চ বাজারমূল্য সাড়ে তিন কোটি টাকা। এখানেও অতিরিক্ত মূল্য দেখানো হয়েছে প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সিএমএসডির তৈরি করা তালিকা অনুযায়ী যদি বিভিন্ন মেশিন কেনা হয়, সেক্ষেত্রে সব মিলিয়ে শতকোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে সরকারের।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, হাসপাতাল থেকে ক্রয় তালিকা অধিদফতরে পাঠানো হলে সেটা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় থেকেই সব কিছু চূড়ান্ত করা হয়। তাছাড়া সিএমএসডিতে প্রাইজ ফিক্সেশন কমিটি সভা করে মূল্য নির্ধারণ করে থাকে।

সিএমএসডি’র প্রণীত ওই তালিকার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো) ও ক্রয় কমিটির প্রধান ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এটি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় আছে। ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এটি পাস হবে। তারপর স্বাস্থ্য অধিদফতরের মূল্যায়ন কমিটি এটি যাচাই-বাছাই ও মূল্যায়ন সাপেক্ষে চূড়ান্ত করবে। তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পরই সিএমএসডি টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করবে।

সূত্রে আরও অভিযোগ, একশ্রেণীর মুনাফালোভী ব্যবসায়ী এবং অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে প্রতি অর্থবছরেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এ ধরনের ক্রয় তালিকা পাঠানো হয়। তারপর বিভিন্ন ডেক্স ‘ম্যানেজ’ করে এভাবেই অতিরিক্ত মূল্যে যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/04/27/120474/