২৭ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:২৬

হাওরবাসীর কান্না

ভারতের ৫টি ড্যাম আর অসময়ে বৃষ্টিপাতই কাল হল

প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করতে বিশ্লেষকদের আহবান

অসময়ে ভারিবর্ষণ ছাড়াও চারটি সীমান্ত নদীর ড্যাম (বাঁধ দিয়ে ভারতের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প) কাল হয়ে দাঁড়াল হাওরবাসীর। সুনামগঞ্জে ১৫১ হাওরের বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পেছনে এখানকার ৫টি ড্যাম কোনো নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে কিনা তা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। বিষয়টি নিয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান করার জন্য কেউ কেউ সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তাদের মতে, শুধু পাহাড়ি ঢলে পানির এ রকম ভয়াবহ চাপ হওয়ার কথা নয়।


বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ও পরিবেশ পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনের মতে, সীমান্ত নদীর ভারতের অংশে থাকা ড্যামগুলো বাঁচাতেই পানি ছেড়ে দেয়া হতে পারে। এমন আশঙ্কার বিষয়ে সরকারিভাবে খোঁজখবর নেয়া উচিত। তিনি বলেন, অসময়ে হঠাৎ করে এত পানি যেহেতু বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সে কারণে মেঘালয় রাজ্যের নদীগুলোতে ভারতের যে ক’টি জলবিদ্যুৎ ও ইরিগেশন প্রকল্প রয়েছে সে বিষয়ে খোঁজ নিতে হবে। বাঁধে কোনো ত্রুটি আছে বা হয়েছে কিনা তা অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন। অবশ্য এ বিশেষজ্ঞ এ-ও মনে করেন, উজানে বাঁধ থাকলে যে কোনো দেশই তার বাঁধ বাঁচাতে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেবে, এটাই স্বাভাবিক। এখন বাস্তবে তেমনটি ঘটেছে কিনা সে বিষয়ে খোঁজ নেয়া দরকার।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম জানান, এ বছর এ অঞ্চলে গত ২০ বছরের তুলনায় বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর পাশাপাশি মেঘালয়ে এ সময়ে যে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে তা অস্বাভাবিক। তার দেয়া তথ্যমতে, ২৯ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৯ দিনে সিলেটের ৯টি পয়েন্টে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৫০৮৮ মিলিমিটার, যা ১৯৯৭ সালের পর সর্বোচ্চ। আর এই পুরো পানিই ধারণ করতে হয়েছে সিলেট অঞ্চলের এসব নদীকে। অন্যদিকে মেঘালয় এবং আসামের চারটি পয়েন্টে এই ৯ দিনে বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ২২৫৩ মিলিমিটার। যার মধ্যে সুনামগঞ্জের ওপারের চেরাপুঞ্জিতেই ১১৮৬ মিলিমিটার। এ সময়ে এত বৃষ্টিপাতের রেকর্ড অতীতে ছিল না বলেও জানান তিনি। কিন্তু এসব পানি নদীগুলো ধারণ করলেও সুরমার সঙ্গে যেখানে মিলিত হয়েছে সেদিকে যে গতিতে যাওয়া প্রয়োজন তা হয়নি। এতে করে হাওরের পাশের নদীতে পানির পরিমাণ বাড়তে থাকে।

তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কর্মকর্তার কথার কিছুটা মিল পাওয়া গেল যাদুকাটা নদীর উৎসমুখে থাকা স্থানীয়দের কথায়। স্থানীয় ষাটোর্ধ্ব কাসেম আলী বললেন, এবার বৈশাখে যত পানি ভারত থেকে যাদুকাটায় এসেছে তা তার এই বয়সে দেখেননি। তিনি বলেন, পানি আসে জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝিতে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদীর উৎপত্তি হয়েছে মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা উমট্রু– নদী থেকে।

ভারতের ‘ওয়াটার রিসোর্সেস ইনফর্মেশন সিস্টেম’ ওয়েবসাইটের তথ্যমতে উমট্রু– নদীতে তিনটি জলবিদ্যুৎ ও ইরিগেশন ড্যাম রয়েছে। বাকি দুটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এখানকার অন্যান্য নদীতে।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, সুনামগঞ্জ জেলায় প্রায় ২৬টি ছোটবড় নদ-নদী রয়েছে। যার মধ্যে সুরমা, কুশিয়ারা, কালনী, রক্তি, যাদুকাটা, চলতি, বৌলাই, মরাচেলা অন্যতম। এর মধ্যে যাদুকাটা দিয়ে সবচেয়ে বেশি পানি সুনামগঞ্জে প্রবেশ করে। তাই যাদুকাটা, চলতি, মরাচেলা ও খাসিয়ামারা নদীকে এ অঞ্চলের দুঃখ বলা হয়ে থাকে।

দীর্ঘদিন ধরে হাওরের পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ও পরিবেশ প্রকৌশল অধিদফতরের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে আরও বলেন, হাওরের পানি ব্যবস্থাপনার চরিত্র বুঝতে হলে এর পানির উৎস ও হাওরের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান আগে জানতে হবে। বাংলাদেশের পূর্বে ভারতের মেঘালয় ও আসাম অঞ্চলের উঁচু পাহাড়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ওই বৃষ্টির পানি একসঙ্গে জমে ঢল আকারে সাগরে পরিবাহিত হওয়ার জন্য নিচে নেমে আসে। ওই অঞ্চলে বিদ্যমান নদীগুলোর একসঙ্গে এত পানি পরিবহন করার ক্ষমতা না থাকায় পানি চারপাশের নিচু জায়গায় প্রবেশ করে বৃহৎ জলাশয় সৃষ্টি করেছে। এ জলাশয়ের দুটি অংশ। একটি স্থায়ী জলাশয়, যার পানি সারা বছর থাকে। অন্য অংশটি অস্থায়ী, যার পানি শুধু বর্ষা মৌসুমে জমা হয় এবং কয়েক মাস অস্থায়ীভাবে জমা থাকে। এ দুই পানির অংশই মিলিতভাবে হাওর বা হাওরাঞ্চল নামে পরিচিত। হাওরে পানি জমা অবস্থায় ততদিন থাকে, যতদিন ওপরের ঢল ও নদীর পানি বের করে দেয়ার ক্ষমতার মধ্যে সাম্যতা থাকে। ওপরের ঢল বন্ধ হয়ে গেলে নদীর মাধ্যমে পানি সাগরে চলে যায় এবং হাওরের দ্বিতীয় অংশ প্রায় শুকিয়ে যায়। এটি জলজ পরিবেশের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শাখাকে নির্দেশ করে, যা বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। তাই এর পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার জন্য সতর্কতার সঙ্গে হ্যান্ডেল করা প্রয়োজন।

সূত্র জানায়, কোনো নদী বা খালের বেসিন হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট পয়েন্টের ওপরদিকের যেসব অঞ্চলের বৃষ্টির পানি বা ঢলের পানি পরিবহন করে। বেসিনের পানির পরিমাণ সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত থেকে সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করতে হবে এবং সে সাপেক্ষে নদী বা খালের পানি পরিবহন ক্ষমতা বাড়াতে হবে। বেসিনের পানির পরিমাণ এমনভাবে নির্ণয় করতে হবে যাতে আগাম বর্ষা বা অতিবৃষ্টির পানি সংযুক্ত থাকে এবং মোটের ওপর ৫ থেকে ২৫ ভাগ পর্যন্ত ইমারজেন্সি পানি সারপ্লাস হিসেবে সংযুক্ত করতে হবে। সর্বমোট বেসিনের পানি হিসাব করার পর নদী ও খালকে এমনভাবে খনন করতে হবে, যাতে হাওরের পানি ২-৩ দিনের মধ্যে নেমে যায়। সে জন্য নদীকে ও সংযুক্ত সব নদীকে ভাটি পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে খনন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা নিতে হবে। এ ছাড়া পাহাড়ের পাদদেশের কিছু দূরে বিশেষ সুগভীর খাল খনন ও এক পাড় উঁচু করে শক্তপোক্ত বাঁধ দিয়ে পাহাড়ি ঢল ও ঢলের বিধ্বংসী গতি সামান্য হলেও কিছু সময়ের জন্য রোধ করা যায়।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/04/27/120478/