৯ জুলাই ২০২৩, রবিবার, ৪:২২

সারা বছরই টাকার সঙ্কটে ভোগে ব্যাংকগুলো

বিদায়ী অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে রেকর্ড ডলার বিক্রি

বাজার থেকে দেড় লাখ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক

বিদায়ী অর্থবছরে ব্যাংকিং খাতে কাক্সিক্ষত হারে আমানত সংগ্রহ হয়নি। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর ডলার সঙ্কট সারা বছরই ভোগায়। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে রেকর্ড ডলার বিক্রি করতে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। বিপরীতে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হয়েছিল ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে এ পরিমাণ ডলার আর কখনো বিক্রি করা হয়নি। আগের অর্থবছরে যা ছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। এক বছরে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বেড়েছে ৭৮ দশমিক ২২ শতাংশ। রিজার্ভ থেকে রেকর্ড ডলার বিক্রি করায় এক দিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে বেড়ে গেছে, অপর দিকে, ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার সঙ্কটে ভোগে। এ সঙ্কট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপো ও বিশেষ রেপোর আওতায় সারা বছরই ধার করতে হয় কিছু কিছু ব্যাংকের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ৩ জুলাই রেপো, বিশেষ রেপো ও বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতায় কয়েকটি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ধার নিয়েছে ৪ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। একইভাবে নগদ টাকার সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলো গত ২ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ধার করেছে ৩ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বিদায়ী বছরে ব্যাংকগুলো নানাবিধ সঙ্কটের মধ্যে পার করে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ডলার সঙ্কট ও নগদ টাকার সঙ্কট। নগদ টাকার সঙ্কট হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, ব্যাংকগুলো কাক্সিক্ষত হারে আমানত সংগ্রহ করতে পারেনি।

কারণ হিসেবে একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে তা বিনিয়োগকারীদের মাঝে বিনিয়োগ করে থাকেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে শিথিলতার ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত হারে ঋণ আদায় হয়নি। অপর দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায়। কোনো কোনো পণ্য এক বছরেই দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষের আয় ওই হারে বাড়েনি বরং ডলার সঙ্কটে অনেক প্রতিষ্ঠান এলসি খুলতে না পেরে তাদের কারখানার উৎপাদন অর্ধেক নামিয়ে এনেছে। এতে লোকসানের ধকল কাটাতে শ্রমিক ছাঁটাই করতে হয়েছে। ফলে অনেক কর্মক্ষম শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে। এতে কমে গেছে মানুষের আয়। কিন্তু পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ব্যয় বেড়ে গেছে। আয় কমে যাওয়ার বিপরীতে ব্যয় না কমে বরং বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই তার প্রান্তিক সঞ্চয়টুকু ভেঙে ফেলেছে। এভাবেই কমে গেছে আমানত। এক দিকে, ঋণের অর্থ ফেরত না পাওয়ার পাশাপাশি আমানত কমে যাওয়ায় কিছু ব্যাংকের নগদ টাকার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, নগদ টাকার সঙ্কট বেড়ে যাওয়ার আরো কারণ হলো ডলার সঙ্কট। ডলার সঙ্কট সারা বছরই ব্যাংকগুলোকে ভুগিয়েছে।

এ দিকে ডলার সঙ্কটের কারণে ব্যাংকগুলো গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারেনি। এর ফলে সামগ্রিক আমদানি কমে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারি ব্যাংকসহ কিছু ব্যাংকের অতি প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল, সার, ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য কিছু ডলার সরবরাহ করেছে। ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নগদ টাকা দিয়ে ডলার কিনে নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২১-২২ অর্থবছরে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছিল ৭২০ কোটি ডলার বা ৭.৬২ বিলিয়ন ডলার। সেটা বিদায়ী অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করেছে ১ হাজার ৩৫৮ কোটি ডলার বা ১৩.৫৮ বিলিয়ন ডলার। এ রেকর্ড ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। বাজার থেকে টাকা তুলে নেয়ায় অনেক ব্যাংকই নগদ টাকার সঙ্কটে পড়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সারা বছরই নগদ টাকার সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোকে নানা উপকরণের মাধ্যমে টাকার জোগান দিয়েছে।

যেমন, গত তিন জুলাই চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাত দিন মেয়াদি রেপোর মাধ্যমে ধার নিয়েছে ২ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদ গুনতে হয় ৬.৬০ শতাংশ সুদ। দুইটি ব্যাংক এক দিনে মেয়াদি বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতায় ১ হাজার ৯১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধার নিয়েছে। এজন্য সুদ গুনতে হয় সাড়ে ৬ শতাংশ।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/760857/