৮ জুলাই ২০২৩, শনিবার, ১২:১৭

মুহূর্তেই নদী গর্ভে ঘরবাড়ি-পাকা সড়ক

নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে তীব্র হচ্ছে নদী ভাঙন। তিস্তার ভাঙনে নীলফামারি কুড়িগ্রাম ও রংপুর এসব জেলায় বিভিন্ন স্থানে বিলীন হচ্ছে ঘর বাড়ি, ফসলি জমি। কুড়িগ্রামে ধরলার ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে মুজিব কেল্লা। অন্যদিকে যমুনার পানি বৃদ্ধিতে সিরাজগঞ্জের চৌহালী, শাহজাদপুর ও এনায়েতপুরে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। ইতোমধ্যেই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে স্কুল, বসতবাড়ি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ফসলি জমি। ভিটেমাটি আর বসতবাড়ি হারিয়ে দিশেহারা নদীপাড়ের মানুষ। যমুনায় পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে টাঙ্গাইলে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। অব্যাহত ভাঙনে টাঙ্গাইল সদর, ভূঞাপুর, কালিহাতী, নাগরপুর ও মির্জাপুর উপজেলার প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রামের বসতভিটা, ঘরবাড়িসহ ফসলি জমি নদী গর্ভে চলে যাচ্ছে। ভাঙনের ফলে গৃহহীন মানুষ খোলা আকাশের নিচে, রাস্তায়, বাঁধে ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। হুমকিতে রয়েছে ভাঙনকবলিত এলাকার বেশ কয়েকটি স্কুল, মসজিদসহ বহু স্থাপনা। অব্যাহত ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের চিতুলীয়া পাড়াসহ ২০ গ্রামের মানুষ মানববন্ধনসহ সড়ক অবরোধ করে। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের বাধ্যকর পাড়া, পালপাড়া ও ফতেপুর বাজার এলাকায়ও বংশাই নদীর ভাঙন তীব্র রূপ নিয়েছে।

টাঙ্গাইল জেলা সংবাদদাতা জানান, ভূঞাপুরের চিতুলীয়া পাড়াসহ ২০টি গ্রামে দেখা দিয়েছে যমুনার তীব্র ভাঙন। ভাঙনে নদী গিলে খাচ্ছে বসতভিটা, ফসলি জমিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। অব্যাহত ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে মানববন্ধনসহ সড়ক অবরোধ করে এলাকাবাসী। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ২ঘন্টা ভূঞাপুর-বঙ্গবন্ধু সেতু সড়কের চিতুলিয়া পাড়া এলাকায় এ কর্মসূচি পালন করে তারা। এতে শত শত মানুষ অংশ নেন। অবরোধের কারনে উভয় পাশে যানবাহনের দীর্ঘ সারির সৃষ্টি হয়। দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রীদের।

এদিকে খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. বেলাল হসেন। তিনি তাৎক্ষণিক ভাঙনকবলিত এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলার ঘোষণা দেন। পরে বিক্ষোভকারীরা অবরোধ তুলে নেন। চিতুলীয়া পাড়ার গ্রামের দারা মিয়া বলেন, কিছুদিন আগে স্থানীয় সাংসদ এসে বলে গেল অতিদ্রুত বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হবে। অথচ গত এক সপ্তাহে তিন শতাধিক বসতভিটা ও কয়েকশ বিঘা ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেল। ভাঙন বন্ধ করতে কোনো কাজ শুরু তো দূরের কথা, কেউ খোঁজখবর নিতেও আসেনি।

সরজমিন ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শনকালে জানা গেছে, গেল দুই সপ্তাহে বংশাই নদীর ফতেপুর অংশে অন্তত ২০-২৫টি বাড়ি নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে বাস্তুহারা হয়েছেন প্রায় ১৫-২০টি পরিবার। ফতেপুর বাজারের প্রায় ২০টি দোকান ঘর সম্পূর্ণরূপে নদীর গর্ভে চলে গেছে। নদী ভাঙনের শিকার হয়ে বাস্তুহারা হওয়া বেশ কয়েকটি পরিবারকে দেখা গেছে, প্লাস্টিকের তাঁবু টানিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে।

এছাড়া বংশাই নদীতে পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে কুরণী-ফতেপুর আঞ্চলিক পাকা সড়কের প্রায় ৪০০ মিটার একেবারে নদীতে বিলীন হয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ফলে ফতেপুর বাজারের পূর্বাংশে বসবাস করা মানুষজন যেমন ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদ, ফতেপুর বাজারে যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটি হারিয়ে বিচ্ছিন্ন অবস্থার মধ্যে পড়েছেন একইভাবে ওই এলাকার স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার বিষয়টিও মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, শুকনো মৌসুমে নদী পাড়ে ভেক্যু দিয়ে মাটি কাটা আর বর্ষাকালে ড্রেজার দিয়ে মাটি উত্তোলনের কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। ফলে নদীতে পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে এই ভাঙন দেখা দিয়েছে। এছাড়া খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বংশাই নদীতে পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে বংশাই নদী সংলগ্ন গোড়াইল, কুমারজানি, চাকলেশ্বর, ত্রিমোহন এলাকায় আরো অন্তত শতাধিক বাড়ি ঘর ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে।

উজানের পাহাড়ি ঢল আর টানা বৃষ্টির কারণে টাঙ্গাইলে যমুনাসহ অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন উপজেলার প্রায় অর্ধশাতাধিক গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনের ফলে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন নদী তীরের মানুষ। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে বার বার বাঁধ নির্মাণের আশ্বাস দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। স্থায়ী গাইড বাঁধ নির্মাণের দাবী এলাকাবাসীর। এছাড়া চরাঞ্চলে তিল ও পাটসহ নানা ধরণের ফসল পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন চরাঞ্চলবাসী।

নদী ভাঙনের শিকার ভূঞাপুর উপজেলার চিতুলিয়াপাড়া গ্রামের জিলকদ বলেন, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। এক দিনেই আমার বসতভিটা যমুনায় চলে গেছে। বাড়ির পাশে থাকা জমিও নদীগর্ভে চলে গেছে বহু আগেই। এখন সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমার থাকার জায়গাটুকুও আর নেই। আমরা ভাঙন কবলিতরা ত্রাণ চাই না, ভাঙনরোধে বাঁধ চাই।

কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা জানান, বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে পানি বাড়ছে কুড়িগ্রামের নদ-নদীতে। এতে শুরু হয়েছে নদী ভাঙন। এরই মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ফুলবাড়ি উপজেলার নাওডাঙা ইউনিয়নের গোরকম-প গ্রামের শতাধিক বসতবাড়ি। আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন নদী পাড়ের মানুষরা। অনেকেই আশ্রয় নিচ্ছেন অন্য জায়গায়। আবার কেউ বা সব হারিয়ে ঠাঁই নিচ্ছে সরকারি বাঁধে। সরেজমিনে দেখা যায়, নাওডাঙা ইউনিয়নের গোরকম-প এলাকায় রয়েছে দুটি মাদরাসা, স্কুল ও দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে একটি মুজিব কেল্লা। অথচ খামখেয়ালিপনার কারণে উপজেলা যাওয়ার একমাত্র বাঁধটি ভাঙতে বসেছে। এ অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে

মানুষের বসতবাড়িসহ বিলীন হয়ে যাবে সরকারি বেসরকারি সব স্থাপনা।
যমুনায় পানি বৃদ্ধি : কাজিপুরে ধ্বসে গেল সলিড স্পারের ৩০ মিটার
সিরাজগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, যমুনায় পানি বাড়তে থাকায় ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি হয়ে ধ্বসে গেছে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর সলিড স্পারের ৩০ মিটার এলাকা। গতকাল ভোরে কাজিপুর যমুনা নদীর মেঘাই ১ নম্বর সলিড স্পার এলাকায় এ ধ্বস দেখা দেয়। এ বাঁধটি পুরোপুরি ধ্বসে গেলে উপজেলার বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।

কাজিপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান বিপ্লব জানান, যমুনা নদীতে গত কয়েকদিন ধরে পানি বাড়ছে। পানি বাড়ার ফলে গতকাল ভোর থেকে মেঘাই ১ নম্বর সলিড স্পার এলাকায় ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি হয়। এতে মুহূর্তেই স্পারের ৩০ থেকে ৪০ মিটার নদীগর্ভে চলে যায়। তিনি বলেন, এ স্পারটি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হলে কাজিপুর থানা, খাদ্য গুদাম, রেজিস্ট্রি অফিস, কাজিপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে পড়বে। কাজিপুর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাজী অনিক ইসলাম জানান, ইউপি চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান বিপ্লব আমাকে স্পার ধ্বসে যাওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন। তাৎক্ষণিকভাবে আমি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। পাউবোর লোকজন ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান জানান, ঘটনাস্থলে আমরা দ্রুত আসি। সলিড স্পারের অন্তত ৩০ মিটার এলাকা ধ্বসে গেছে। আপাতত জিও ব্যাগ ফেলে ধস ঠেকানোর চেষ্টা চলছে। ১৯৯৭ সালে কাজিপুর উপজেলা রক্ষায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমের প্রচেষ্টায় মেঘাই খেয়াঘাট এলাকায় ৩০০ মিটার স্পার নির্মাণ করা হয়। ২০১২ ও ২০১৩ সালে স্পারটির মূল অংশের ১৫০ মিটার ধ্বসে যায়। পরে স্পারের মাটির অংশটুকু রক্ষায় সিসি ব্লক দিয়ে প্রটেকশন দেওয়া হয়। গতকাল শুক্রবার সেই অংশের ৩০ মিটার নদীগর্ভে বিলীন।

https://dailyinqilab.com/national/article/585933