৪ জুলাই ২০২৩, মঙ্গলবার, ১০:৫৪

খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকল বন্ধের ৩ বছর অতিবাহিত

পাটকল চালুর অপেক্ষায় শ্রমিকরা

খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকল বন্ধের তিন বছর অতিবাহিত হয়েছে। ভালো নেই চাকরিহারা প্রায় অর্ধলাখ শ্রমিক। পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন কাটছে তাদের। তবুও পাটকল চালু হবে সেই আশায় বুক বেঁধে রেখেছেন শ্রমিকরা। সাইরেন বাজবে, সেই অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। এদিকে মিল বন্ধ থাকায় অযতেœ নষ্ট হচ্ছে ৯টি পাটকলের ৫ হাজার ৮৩টি তাঁত ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। ফলে আবার এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে মিলগুলো উৎপাদনে যেতে পারবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

শ্রমিকরা জানান, লোকসানের কারণ দেখিয়ে ২০২০ সালের ২ জুলাই রাষ্ট্রায়ত্ত ক্রিসেন্ট, প্লাটিনাম, খালিশপুর, দৌলতপুর, স্টার, ইস্টার্ণ, আলিম, যশোরের জেজেআই ও কার্পেটিং জুট মিল বন্ধ করে দেয় সরকার। লিজের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করে তিন মাসের মধ্যে মিলগুলো আবার চালুর ঘোষণা দিয়েছিল বিজেএমসি। কিন্তু এখনও চালু হয়নি। তাদের কেউ কেউ অন্য পেশায় ঢুকলেও অনেকেই বেকার। খালিশপুর, দিঘলিয়া ও আটরা শিল্প এলাকার পাটকল বন্ধ হওয়ায় ওই এলাকার মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। অনেকে এলাকা ছেড়ে নিজ জেলায় সপরিবারে ফিরে গেছেন। বন্ধ হয়ে গেছে মিল কারখানা কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও দোকানপাট। নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে শিল্প এলাকা।

প্লাটিনাম জুটমিলের শ্রমিক মিজানুর রহমান বলেন, মিল বন্ধের সময় বলা হয়েছিল তিন মাসের মধ্যে চালু করা হবে। কিন্তু আজ তিনটি বছর পার হয়েছে। এখনও মিল চালু হয়নি। বেকার হয়ে কষ্টে দিন কাটছে। মাঝে ঢাকা একটি শো-রুমে চাকরি করেছি। পরে সেখান থেকে চলে আসতে হয়েছে। পরিবারে তিন ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী ও আমিসহ ৫ জন। সংসারের খরচ, লেখাপড়া, চিকিৎসা খরচসহ ঊর্ধ্বগতির বাজারে ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মাঝে মধ্যে কাজ পেলে করি না হলে বেকার বসে থাকতে হয়। বর্তমানে একটি কম্পিউটার দোকানে কাজ করছি। তিনি বলেন, মিলের সামনে ও কলোনি দেখলে বুকটা হাহাকার করে ওঠে। কষ্ট লাগে। কবে যে আবার মিল চালু হবে, মিলের প্রবেশ করার জন্য সাইরেন বাজবে। শুনেছি প্লাটিনাম জুট মিল লিজ দেওয়া হচ্ছে। মিল চালু হলে আমাদের উপকার হবে।

খালিশপুর প্লাটিনাম জুট মিলের মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের শ্রমিক ছিলেন আব্দুল জলিল। ১৯৯৬ সালে চাকরিতে যোগদান করেন। ২০২০ সালের জুলাইয়ের শুরুতেই মিলের উৎপাদন বন্ধ করে দেয় সরকার। এরপর বেকার হন জলিল। তিনি অবসরের অর্ধেক টাকা পেলেও পাননি সঞ্চয়পত্রের টাকা। সঞ্চয়পত্রের টাকার জন্য তিন বছর ধরে ঘুরছেন মেইল দপ্তরে। বর্তমানে প্লাটিনাম জুট মিলের সামনেই একটি দোকা ভাড়া নিয়ে চা, বিস্কুট, রুটি, কলা বিক্রি করে কোনোরকম দিন পার করছেন। অসুস্থ সন্তানের চিকিৎসা, বাড়ি ভাড়া, লেখাপড়াসহ সংসারের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

তিনি বলেন, আজ তিন বছর মিলটি বন্ধ রয়েছে। মিল বন্ধের পর পাওনা অর্ধেক টাকা পেয়েছি। এখনো সঞ্চয়পত্রের ৬ লাখের বেশি টাকা পাওনা রয়েছে। তিন বছর ধরে মিলের দপ্তরে ঘুরছি। কিন্তু এখনও সঞ্চয়পত্রের টাকা পরিশোধ করেনি মিল কর্তৃপক্ষ। শুরুতে বলেছিল জাতীয় পরিচয় পত্র (এনআইডি) নম্বারে সমস্যা। নম্বার ভুল বসিয়েছিল অফিস। এরপর বলা হয় এনআইডি এবং গেট পাসে নামের ভুল রয়েছে। পরে অনেক কাগজপত্র জমা দিয়েও এখন পর্যন্ত কাজ হয়নি। আজ পর্যন্ত তার খেসারত দিতে হচ্ছে। জলিল আরও বলেন, মিলের ২ নম্বর গেটের পাশে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে চার সদস্যের পরিবার বসবাস করছি। মিল বন্ধের পর ছোট এই দোকান দিয়েছি। তবে আগের মত বেচাকেনা নেই। বেচাকেনা কমে ১০ ভাগের এক ভাগে এসে নেমেছে। দোকানের আয় দিয়ে বাজার ও চার সদস্যের সংসার চলে না। মিলের টাকা এই পাবো পাবো বলে তিনটি বছর পার হয়ে গেছে। সবশেষে এক মাস আগে টিআইএন সার্টিফিকেট জমা দিয়েছি। মিল কর্তৃপক্ষ বলেছিল ঈদের আগেই পাওনা টাকা পাব। অথচ এখন বলা হচ্ছে ঈদের পরে দেওয়া হবে। ধার দেনা করে চলতে হচ্ছে। মানুষের কাছে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা দেনা রয়েছি। খুব অভাব অনটনে সংসার চলছে।

একই মিলের আরেক শ্রমিক মোহাম্মদ আলী বলেন, মিল বন্ধের তিন বছর অতিবাহিত হয়েছে। এখনো পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রের টাকা পাইনি। মিলের কাছে ১৬ লাখ ৬৪ হাজার টাকা পাওনা ছিল। যার মধ্যে নগদে অর্ধেক পেয়েছি। বাকি ৮ লাখ ৩২ হাজার টাকা সঞ্চয়পত্রে পাওনা রয়েছে এখনও। গত তিন বছর সংসারের হানি টানতে টানতে নগদ অর্থ সবই শেষ। নিজের কোনো কাজ নেই। তবুও ছয় সদস্যের পরিবার চালাতে হয়। এক ছেলে এক মেয়ে নাতি-নাতনি ও স্ত্রীকে নিয়ে হাউজিং বাজার এলাকায় ভাড়া বাড়িতে বসবাস করি। অনেক কষ্টে আছি, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। গেল তিন বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি, তবুও সঞ্চয়পত্র পাইনি। মিল বন্ধ করে আমাদের পথে বসিয়েছে। এই বয়সে কোথাও কাজ করার সুযোগ নেই। এক ছেলে পরিবহনে কাজ করে। তার আয় দিয়ে সংসার চলে না। মেয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের লেখাপড়া করে। চিকিৎসাও করাতে পারি না। এখন দেনা হয়ে গেছি। ঘর ভাড়া, বাজার-ঘাট, লেখাপড়ার খরচ মেটাতে পারি না। এখন আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। দ্রুত পাওনা পরিশোধ এবং মিল চালুর দাবি জানান তিনি।

ক্রিসেন্ট জুট মিলের শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. সোহরাব হোসেন বলেন, মিল বন্ধের আগে শ্রমিকদের সকল পাওনা পরিশোধ এবং দ্রুত মিল চালু করা হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আজ তিনটি বছর পার হতে চলেছে। এখনও অনেক শ্রমিকের সঞ্চয়পত্রের টাকা পাওনা রয়েছে। মিল চালুর ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত এখনও আমরা জানতে পারিনি। ২৬টি মিল বন্ধের পর শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়ে। অনেকে দিনমজুর, রিকশা, ভ্যান, ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে। অনেকেই কর্ম হারিয়ে নিজ গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। শ্রমিকরা অনেক কষ্টে রয়েছে। আমাদের দাবি শ্রমিকদের সকল পাওনা পরিশোধ করা হোক। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় মিলটি চালু করা হোক।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক খলিলুর রহমান বলেন, পাটকল বন্ধের পর থেকে শ্রমিকরা কষ্টে আছে। মিল চালুর প্রতিশ্রুতি থাকলেও অগ্রগতি নেই। তিনি বলেন, বিআইডিসি সড়কের আলমনগর মোড় থেকে নতুন রাস্তা মোড় পর্যন্ত অর্ধেক দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে।

বিজেএমসি সূত্র জানায়, মিলগুলোর কাছে ২১৪ শ্রমিকের নগদ ৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং ১ হাজার ৩১৫ শ্রমিকের ৭৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র পাওনা রয়েছে।

বিজেএমসির খুলনা আঞ্চলিক সমন্বয়কারী মো. গোলাম রব্বানী বলেন, মাসখানেক আগে যশোরের জেজেআই জুট মিল আকিজ গ্রুপকে লিজ দেওয়া হয়েছে। তারা শিগগিরই মিলটি চালুর চেষ্টা করছে। খুলনার প্লাটিনাম জুট মিল ফরচুন গ্রুপকে লিজ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। অন্য ছয়টি পাটকল লিজ দেওয়ার জন্য জুনের মাঝামাঝি তৃতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আর আলিম জুট মিলের মালিকানা সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব থাকায় এটি লিজ দেওয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। তিনি বলেন, অধিকাংশ শ্রমিকের টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। কিছু সংখ্যক শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা, নামের ভুলসহ বিভিন্ন প্রকার জটিলতা থাকায় তারা এখনও সব টাকা পাননি। সেগুলোও পর্যায়ক্রমে পরিশোধের চেষ্টা চলছে। যন্ত্রপাতিগুলো মাঝেমধ্যে মেইনটেন্যান্স ও চালু করে দেখা হচ্ছে। কিন্তু যেভাবে মেইনটেন্যান্স করা দরকার, তা অর্থাভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না।

এদিকে কালো দিবস ঘোষণা ও পদযাত্রার মধ্য দিয়ে খুলনার নয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের তিন বছর পালিত হয়েছে। এ সব কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন পাটকল রক্ষায় নাগরিক পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ খুলনা জেলা আহ্বায়ক জনার্দন দত্ত নান্টু। সদস্য সচিব এস এ রশিদের পরিচালনায় বক্তৃতা করেন নাগরিক নেতা ডা. মনোজ দাস, গণসংহতি আন্দোলন খুলনা জেলা আহ্বায়ক মুনীর চৌধুরী সোহেল, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম খুলনা জেলা সভাপতি কোহিনুর আক্তার কণা, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট খুলনা জেলা সভাপতি আবদুল করিম, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আল আমিন শেখ, শ্রমিক নেতা মো. নূরুল ইসলাম, মো. আবুল কালাম প্রমুখ। শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলাম বলেন, তারা পদযাত্রা শুরু করলে খালিশপুর মিল গেটে ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তারপরও তারা তাদের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি পালন করেন।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, লিজ বা ব্যক্তি মালিকানায় নয়, বন্ধ সকল পাটকল অবিলম্বে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চালু, ৫টি পাটকলের (খালিশপুর ও দৌলতপুর জুটমিল, জাতীয় জুটমিল এবং কেএফডি ও আরআর জুটমিল) শ্রমিকসহ সকল শ্রমিকের বকেয়া পাওনা (এরিয়ার, একটি বোনাস, একটি ইনক্রিমেন্ট, ৮টি বোনাসের ডিফারেন্স ২০২০ সালের জুলাই মাসের ২ দিনের মজুরি) ও অবশিষ্ট শ্রমিকের সঞ্চয়পত্রের কাগজ অবিলম্বে দিতে হবে। বক্তারা বলেন, লিজ ও পিপিপির নামে রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যক্তি লুটেরা পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। এমনকি বিভিন্ন মিল থেকে যন্ত্রপাতি-মালামাল চুরি-পাচারসহ নানা অভিযোগ তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

অপরদিকে যশোরের জেজেআই মিল গেটের সামনে কালো পতাকা মিছিল করে শ্রমিকরা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মো. ওমর আলী, ফারুক হোসেন, ইউসুফ আলী, মো. নূরুল ইসলাম, আবদুল খালেক, আল আমিন, রেজাউল ইসলাম, শামস শারফিন শ্যামন প্রমুখ। বিকেল সাড়ে ৩টায় ফুলতলার ইস্টার্ণগেট এলাকায় কালো পতাকা প্রদর্শন ও পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ কেন্দ্রীয় সদস্য মো. মোজাম্মেল হক খান, সিপিবি ফুলতলা উপজেলা সভাপতি গাজী আফজাল হোসেন, গণসংহতি আন্দোলন ফুলতলা উপজেলা আহ্বায়ক মো. অলিয়ার রহমান প্রমুখ।

https://dailysangram.info/post/528822