৩ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ১১:৪৯

চার বছরে ১৪৮ ভবনের মধ্যে কাজ শেষ মাত্র দুটির

আবশ্যকতা থাকলেও সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই হাতে নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ২৮৪ কোটি টাকার প্রকল্প। ফলে বাস্তবায়ন পর্যায়ে নকশা পরিবর্তনসহ নানা জটিলতায় বিরাজ করছে ধীরগতি। এক্ষেত্রে চার বছর পেরিয়ে গেলেও উপজেলা পর্যায়ে ১৪৮টি নতুন ভবনের মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র দুটির। কাজ চলছে ১৩৫টির। এর মধ্যে পাঁচটির অগ্রগতি এখনো শূন্য। মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পের নির্মাণ ও পূর্ত কাজের অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশ। এদিকে বারবার বেড়েছে মেয়াদ। সেই সঙ্গে তৈরি হয়েছে নতুন করে মেয়াদ ও ব্যয়বৃদ্ধির ঝুঁকি। ‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পে বিরাজ করছে এ অবস্থা। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন ঘেঁটে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় বিদ্যালয়গুলোর ভবন উন্নয়ন এবং নতুন ভবন নির্মাণের বিষয়টি ছিল বিরাট আয়োজন। তাই আবশ্যিকভাবেই সম্ভাব্যতা যাচাই করা দরকার ছিল। কেননা প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় কতটি ভবনের ঊর্ধ্বমুখী নির্মাণ কতটুকু হবে, কোন বিদ্যালয়ে কতটুকু অতিরিক্ত নতুন ভবন প্রয়োজন-এসব বিষয় আগে থেকেই জানা প্রয়োজন। অর্থাৎ কত বর্গফুট বা কত তলা হবে, ভবনের নকশা কেমন হবে-এসবের একটা বাস্তবভিত্তিক ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রকল্প তৈরি করা উচিত ছিল। আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের প্রধান অঙ্গ ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ এবং নতুন ভবন নির্মাণ-উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিটি স্থানের অবস্থার ভিত্তিতে নকশা তৈরি করা ছাড়া উপায় নেই। সেক্ষেত্রে আগেই সার্ভে থাকা দরকার। কিন্তু প্রকল্প তৈরির আগে এবং চলমান অবস্থায়ও সেটি করা হয়নি।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইং) প্রফেসর ড. একিউএম শফিউল আজমের সঙ্গে। রোববার তিনি যুগান্তরকে বলেন, পাঁচ বছর আগের প্রকল্প, তাই সমীক্ষা না করার দায় কার, সেটি বলা মুশকিল। তবে ওই সময় এখনকার মতো সমীক্ষার বিষয়টি বাধ্যতামূলক ছিল না। তাই হয়তো করা হয়নি। তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন দেরি হওয়ার অন্যতম কারণ হলো-এটির বাস্তবায়ন শুরুর পর বিভাগীয় ও জেলা শহরে অবস্থিত বিদ্যালয়গুলো ৬ তলা থেকে ১০ তলায় রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া। এছাড়া করোনাভাইরাস মহামারির সময় প্রকল্পে পুরো কাজই বন্ধ রাখতে হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন এবং আইএমইডির যৌথ সুপারিশ নিয়ে বাস্তবতা বিবেচনায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হতে পারে।

আইএমইডি সূত্র জানায়, প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এটি বাস্তবায়ন করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। নির্ধারিত মেয়াদে কাজ শেষ না হওয়ায় ব্যয়বৃদ্ধি ছাড়াই প্রথমবার মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এতেও শেষ হয়নি কাজ। ফলে দ্বিতীয় দফায় আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু এখনো বাস্তবায়ন সন্তোষজনক নয়। কেননা প্রকল্পের আওতায় সরকারি ৩২৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন, গ্রন্থাগার, বিজ্ঞান ল্যাবরেটরি, কম্পিউটার ল্যাবরেটরি, প্রার্থনা কক্ষ, হোস্টেল, শিক্ষকদের ডরমেটরি এবং প্রধান শিক্ষকের কোয়ার্টার নির্মাণের কথা। এর মধ্যে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অনুযায়ী, ১২৫টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভবন ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের লক্ষ্য আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ১০২টি বিদ্যালয়ের বিদ্যমান ভবন ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণযোগ্য। বাকি ২৩টি বিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের মতো ভবনই নেই। তবে ১০২টির মধ্যে ৭৪টির সম্প্রসারণ কাজ শেষ হয়েছে। ২৮টির কাজ বিভিন্ন পর্যায়ে চলছে। নতুন ভবন তৈরির কাজ সন্তোষজনক নয়। সেই সঙ্গে জেলা ও বিভাগীয় শহরের নতুন ১৭২টি ভবনের কাজ বর্তমানে স্থগিত হয়ে আছে। এছাড়া ২৪টি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হোস্টেল নির্মাণের লক্ষ্য রয়েছে। ইতোমধ্যেই ২১টির দরপত্র আহ্বান করে ১৮টির দরপত্র অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পণ্য হিসাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন ইউনিটের আসবাবপত্র ও অফিস সরঞ্জাম কেনা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্প অফিসের জন্য কেনা হয়েছে তিনটি জিপ এবং একটি মাইক্রোবাস।
আইএমইডির প্রতিবেদনে প্রকল্পের দুর্বল দিক হিসাবে প্রথমেই বলা হয়েছে সম্ভাব্যতা যাচাই না হওয়া। এছাড়া রয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন অবস্থায় জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে ৬ তলা থেকে ১০ তলা করার সিদ্ধান্ত। প্রকল্প পরিচালক ও অন্যান্য জনবল নিয়োগে দেরি হওয়া। প্রকল্প তৈরির সময় যে রেট শিডিউল ধরা হয়েছে, বাস্তবায়ন শুরুর আগেই সেটির পরিবর্তন হওয়াও দুর্বল দিক। ঝুঁকি হিসাবে বলা হয়েছে, নির্মাণসামগ্রীর ঘনঘন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঝুঁকি তৈরি করেছে। এছাড়া প্রকল্পটির আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় মেয়াদ ও ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। পাশাপাশি কোনো কোনো এলাকায় অভিজ্ঞ ও যোগ্য ঠিকাদার এবং নির্মাণকর্মীর অভাব রয়েছে।

পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব মামুন-আল-রশীদ যুগান্তরকে বলেন, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করেই প্রকল্প তৈরি করাটা অবশ্যই একটি অনিয়ম। কেননা দ্রুত প্রকল্প পাশ করিয়ে নেওয়ার মানসিকতা থেকেই তড়িঘড়ি করে এসব কাজ করা হয়। সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন যেমন দায়ী, তেমনই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও দায়ী। এরকম ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকেই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/691639