৩ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ১১:৩১

ভিভিআইপি কাঁচামরিচ

‘শুনহে হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ (চন্ডীদাস)। মনিষীর এই বাণীকে একটি ঘুড়িয়ে বলা যায়, ‘শুনহে মানুষ ভাই, সবার উপরে মরিচ দামি তাহার উপরে নাই’। সত্যিই মরিচের উপর দামি পণ্য আর যেনো কিছু নেই। বাঙালির রসুঁই ঘরে এখন সবচেয়ে দামি মশলা জাতীয় সবজি কাঁচা মরিচ। সবুজ রঙের মরিচ এখন ভিভিআইপি মর্যাদায় উঠে গেছে। রসুঁই ঘরে কাঁচা মরিচ এখন রান্নার অন্যান্য উপকরণ পেঁয়াজ, রসুন, লবণ, আদাকে উপহাস করছে। ছিঁ, ছিঁ তোমরা এতো নীচ! বাস্তবতা হচ্ছে রাজধানী ঢাকার ফ্ল্যাট বাসা থেকে শুরু করে সারাদেশের গ্রামেগঞ্জের ঘরে ঘরে কাঁচা মরিচ নিয়ে আলোচনা। হাটে বাজারে আলোচনার প্রধান বিষয় কাঁচা মরিচের দাম।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য ডিপ্লোমেটের প্রতিবেদন ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র অবরুদ্ধ’ এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড, এস জয়শঙ্করের বক্তব্য ‘প্রতিবেশী দেশগুলোর সব দলের সঙ্গে কাজ করার ক্ষমতা ভারত আয়ত্ত করেছে’ এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। সর্বোত্রই এই দুটি তৎপর্যপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিতর্ক, মন্তব্য, মতামত, আলোচনা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে নেটিজেনরা নানান মন্তব্য-বক্তব্য দিচ্ছেন। এই মন্তব্য-বক্তব্য-আলোচনাকে ছাড়িয়ে গেছে কাঁচা মরিচ। কেউ লিখেছেন, কাঁচা মরিচের নতুন নামকরণ হচ্ছে ‘হাজারি মরিচ’ কেউ লিখেছেন, বাজারে গিয়ে ‘৫০ গ্রাম টিপু মুনশি’ দেন বললেই দোকানি কাঁচা মরিচ দেবে। উল্লেখ, ১৯৭৪ সালে লবনের সের ৮০ টাকা হওয়ায় তখন অনেকেই বলতেন (এক ছটাক আমু দেন; এরশাদের শাসনামলে ‘চিনি জাফর’ শব্দটি ব্যাপক ব্যবহৃত হতো), কেউ লিখেছেন কাঁচা মরিচ রসুঁই ঘরে উচ্চাসনে বসেছে, কেউ লিখেছেন, কাঁচা মরিচের ভেজসগুণ বুঝতে পেরে এতোদিনে কাঁচা মরিচের মূল্যায়ন হয়েছে, আবার কেউ লিখেছেন বিয়ে অনুষ্ঠানে এখন ‘কাঁচা মরিচ’ হতে পারে সবচেয়ে উকপারি উপহার। নানান বক্তব্য-মন্তব্য করছেন নেটিজেনরা। প্রশ্ন হচ্ছে হঠাৎ করে কাঁচা মরিচ ‘ভিভিআইপি’ মর্যাদায় উঠলো কেন? এখন কার নিয়ন্ত্রণে কাঁচা মরিচের বাজার? কোন সিন্ডিকেটের কবলে কাঁচা মরিচ চলে গেছে? এর আগেও ‘ডিম সিন্ডিকেট’ ‘ব্রয়লার মুরগি সি-িকেট’ ‘চাল সিন্ডিকেট’, ‘পেঁয়াজ সিন্ডিকেট’ ‘সয়াবিন তেল সিন্ডিকেট’ করে বাজার কৃতিম সংকট তৈরির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়া হয়েছে। এক সাপ্তাহ আগে জাতীয় সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি স্বীকার করে বলেছেন, ‘সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বিপদ হবে। সিন্ডিকেটের কথা বলা হচ্ছে। এটা ঠিক বড় বড় গ্রুপগুলো একসঙ্গে অনেক বেশি ব্যবসা করে। চাইলে জেল-জরিমানাসহ বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। তবে আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার আমরা সিন্ডিকেট হোতাদের জেলে ভরলাম, জরিমানা করলাম; সেটা হয়তো করা সম্ভব। কিন্তু তাতে হঠাৎ করে ক্রাইসিসটা তৈরি হবে, সেটাও তো সইতে আমাদের কষ্ট হবে।’ বাণিজ্য মন্ত্রীর এই অসহায়ত্ব প্রমাণ করে সরকারের হাতের চেয়ে সিন্ডিকেটের হাত অনেক লম্বা; সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে গেছে প্রশাসনযন্ত্র। অবশ্য সংসদের ওই অধিবেশনে কয়েকজন সংসদ সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিসহ মন্ত্রীরা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত অভিযোগ করেছেন। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ী স্বীকার করলেও সিন্ডিকেটে তিনি নেই বলে জানান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহে কাঁচা মরিচ ১০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। রংপুরে ৮০০ টাকা, কুড়িগ্রামে ৭০০ টাকা, রাজধানী ঢাকার বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ মানভেদে ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। কাঁচা মরিচের আঁতুড় ঘর খ্যাত পাবনায় ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার ভারত থেকে কাঁচা মরিচ আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দাবি করা হচ্ছে আষাঢ় মাসে বৃষ্টির কারণে জমিতে মরিচের গাছ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে গেছে। বাস্তবতা কি তাই বলে? ষড়ঋতুর বাংলাদেশে আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল। প্রতিবছর এই দুই মাসে প্রচুর বৃষ্টি হয়ে থাকে। জমি ভেজা থাকায় মরিচের গাছের ক্ষতি হয়। তবে কোনো বছরেই বৃষ্টির কারণে কাঁচা মরিচের কেজি ২০০ টাকার বেশি হয়নি। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি নিয়ে লতা মঙ্গেশকারের কালজীয় গান ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন/ ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে, তোমাকে আমার মনে পড়েছে’। এই দুই মাসে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় এমন গান রচিত হয়েছে। অথচ এখন তেমন বৃষ্টি হয় না। চলতি বছর বৃষ্টি খুব কম হয়েছে। আষাঢ়ের মাঝামাঝি সময়ে যে পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ার কথা তার অর্ধেক পরিমাণ বৃষ্টিও হয়নি। ফলে বৃষ্টির কারণে মরিচের দাম বেড়েছে এটা যুক্তিতে খাটে না।

রাজধানীর হাট-বাজারগুলোতে কাঁচা মরিচের সরবরাহ অস্বাভাবিক ভাবে কমে গেছে এমনও নয়। প্রতিটি বাজারে কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে। তবে দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতারা ৫০০ গ্রামের বদলে ১০০ গ্রাম, ২৫০ গ্রামের বদলে ১০০ গ্রাম ক্রয় করছেন। হঠাৎ করে কাঁচা মরিচের আকাশছোঁয়া দাম হলো কেন? কেন মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেল কাঁচা মরিচ? নাকি ডিম, ব্রয়লার সিন্ডিকেটের মতো সিন্ডিকেট করে কাঁচা মরিচ সংকটের সৃষ্টি করে হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়ার ফন্দিফিকির করা হয়েছে? জাতীয় সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে সরকার কর্পোরেট হাউজ সি-িকেটের কাছে অসহায়।

তরকারি তথা খাদ্যের স্বাদ বাড়াতে লবণ-রসুন-পেঁয়াজের মতোই কাঁচা মরিচ ব্যবহার হয়ে থাকে। প্রতিদিনের পান্থা ভাত, সকালের নাস্তা, পোলাও-বিরিয়নি, মাছ, গোশত, সবজি যেকোন ঝাল রান্নায় কাঁচা মরিচের ব্যবহার হয়ে থাকে। ইদানিং কুমিল্লার মাতৃভা-ারের রসমালাইয়ের পাশাপাশি ছানার সঙ্গে কাঁচা মরিচ পিষিয়ে পেস্ট করে মিশিয়ে ঝাল রসগোল্লা বানানো হচ্ছে। রসগোল্লায় সবুজ মরিচের ব্যবহার হওয়ায় কি কাঁচা মরিচের চাহিদা বেড়ে গেছে? সেটা হলে তো শুধু কুমিল্লায় দাম বাড়ার কথা। এছাড়াও কাঁচা মরিচের নাকি ওষুধিগুন আবিষ্কৃত হয়েছে। ভেজস চিকিৎসকরা বলে থাকেন সবুজ কাঁচা মরিচে আছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি, যা মানুষের শরীরের জন্য খুব উপকারি। কাঁচা মরিচ সাধারণত কাঁচা, রান্না কিংবা বিভিন্ন ভাজিতে দিয়ে খাওয়া হয়। এতে আছে ভিটামিন এ, সি, বি-৬, আয়রন, পটাশিয়াম এবং খুবই সামান্য পরিমাণে প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট। ঝাল স্বাদের সবজির তরকারিতে থাকে বিটা ক্যারোটিন ও আলফা ক্যারোটিন, বিটা ক্রিপ্টোক্সানথিন ও লুটেইন জিয়াক্সানথিন ইত্যাদি উপাদান। এই উপাদানগুলো মুখে লালা আনে ফলে খেতে মজা লাগে। এছাড়াও এগুলো মহিলাদের ত্বক ও স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। কাঁচা মরিচের স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়ে ভেজস চিকিৎসকরা দাওয়াই দিয়ে থাকেন। সে জন্যই (!) হয়তো কাঁচা মরিচের দাম এখন আকাশচুম্বি। প্রশ্ন হচ্ছে দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতা, অযোগ্যতা, অদূরদর্শিতায় দেশের মানুষের ত্রাহি অবস্থা। সময়ে সময়ে একেকটা পণ্যে দাম আকাশ ছোঁয়া হয়ে যায়। প্রয়োজনীয় ওই সব পণ্য ক্রয়ে মানুষকে চরম বিপাকে পড়তে হয়। অথচ দায়িত্বশীলরা সায়দারা বক্তব্য ‘সিন্ডিকেট’ ‘সিন্ডিকেট’ আমদানি করা হবে, ইত্যাদি বলে জনগণকে ধোকা দেন। এর মধ্যেই সিন্ডিকেটের হোতারা শত শত কোটি টাকা জনগণের পকেট থেকে তুলে নিয়ে যান। প্রশ্ন হচ্ছে এভাবে আর কতদিন চলবে? কথায় আছে সিন্ডিকেটের হাত যত বড় হোক না কেন; সরকারের হাত তার চেয়ে লম্বা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের হাতের চেয়ে সিন্ডিকেটের হাত লম্বা হবে কেন? বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে সেটাই প্রমাণ করে। তাহলে কি জাতীয় সংসদে অন্যান্য এমপিরা যে অভিযোগ তুলেছেন সিন্ডিকেটে মন্ত্রীরা জড়িত সেটাই সত্য? দেশের ভোক্তারা কাঁচা মরিচের ভিভিআইপি মর্যাদা চায় না। চায় ক্রয় ক্ষমতার মধ্য দামের নিয়ন্ত্রণ।

https://dailyinqilab.com/national/article/584800