২ জুলাই ২০২৩, রবিবার

শুধু চামড়ার দামই কমে!

চামড়াজাত পণ্য জুতা-স্যান্ডেলসহ দেশে প্রায় সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে। অথচ চামড়াজাত পণ্যের মূল কাঁচামাল কোরবানির চামড়ার দাম কমেই চলেছে। গত এক দশক ধরে বিশেষ সিন্ডিকেটের কারণে চামড়ার মূল্য নিম্নমুখী। বঞ্চিত হচ্ছেন গরিব ও এতিমরা। এদিকে সারা দেশে কোরবানির চামড়ার দাম নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে মূল্য বেঁধে দেয়া হলেও কোরবানি পশুর চামড়া নিয়ে নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে। মাদ্রাসা ও এতিমখানার মতো প্রতিষ্ঠান যাদের আয়ের অন্যতম উৎস কোরবানির পশুর চামড়া। তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া লাভের আশায় চামড়া কিনে বিপাকে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। সিন্ডিকেটের কারণে চামড়ার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীসহ সারা দেশেই কাঁচা চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন কোরবানিদাতারাও।
এ বছর সরকার ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৫০ থেকে ৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। বাস্তবে বিক্রি করতে গিয়ে এর চেয়ে কম দাম পেয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন অনেকেই। বিশ্ববাজারে চামড়ার দাম বাড়লেও দেশে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না বিক্রেতারা।

বৃহস্পতিবার ঈদের দিন সকাল থেকে রাজধানীর অলিগলিতে দেখা গেছে, বৃষ্টির মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা চামড়া সংগ্রহ করছে। একইভাবে রাজধানীর পোস্তা এলাকায় আড়তগুলোতে সংগ্রহ করা চামড়া জমা দিয়েছেন বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা।
কাঁচা চামড়ার আড়তদাররা জানান, মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের জায়গায় এখন বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা স্থান করে নিয়েছে। পুঁজির অভাবে রাজধানীর অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া সংগ্রহ করা ছেড়ে দিয়েছেন। শুধু রাজধানীই নয়, গ্রামগঞ্জেও অনেক ফড়িয়া চামড়া কেনা ছেড়ে দিয়েছেন।

রাজধানীতে ২৫ থেকে ৩০ ফুট আকারের একেকটি বড় গরুর চামড়া মাত্র ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ নিয়ে চামড়া সংগ্রহকারী মৌসুমি ব্যবসায়ী, ফড়িয়া এবং বিভিন্ন মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ বলেছেন, যে দাম হওয়ার কথা তার চেয়ে অর্ধেক মূল্যে বেচে দিতে হয়েছে চামড়া। অর্থাৎ সিন্ডিকেটের হাতেই ছিল চামড়ার বাজারের নিয়ন্ত্রণ।

এতিমখানা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার তারা গতবারের তুলনায় কিছুটা কম চামড়া সংগ্রহ করেছেন। আর দামও ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৭৫০ টাকার মধ্যেই উঠানামা করেছে। যার কারণে খুব একটা আয়ের মুখ তারা দেখতে পারেননি।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এ বছর সারা দেশে ঈদুল আজহা উপলক্ষে এক কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি পশু কোরবানি হয়েছে। প্রতিটি গরুর চামড়া গড়ে ৬০০ টাকা করে হিসাব করলেও দেশে এবার শুধু গরুর চামড়ার বাজারের আকার ২৭৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকার বেশি।

খামারিরা বলছেন, মানুষ আর্থিকভাবে সংকটে থাকায় এ বছর ছোট পশুর চাহিদা ছিল বেশি। কয়েকজন মিলে ভাগাভাগি করে পশু কোরবানি দেয়ার সংখ্যাও এবার উল্লেখযোগ্য ছিল।

কয়েকজন মৌসুমি ব্যবসায়ী জানান, যে দামে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে তাতে করে লাভ তো দূরের কথা, কেনা দাম উঠছে না। তা ছাড়া গরুর চামড়া বিক্রি করা গেলেও ছাগলের চামড়া কেউ নিচ্ছে না। তবে কেউ কেউ গতবারের চেয়ে দাম বেশি পেয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে ন্যায্য দামেই চামড়া কেনা হচ্ছে জানিয়ে লবণের দাম বাড়ার কারণে বাড়তি দাম দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে দাবি চামড়া ক্রেতাদের।

উল্লেখ্য, আগের বছরগুলোতেও কোরবানির পশুর চামড়ার দাম বেঁধে দেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা মানা হয়নি। কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে কিনে নেয়া হয়েছে পশুর চামড়া। এবার চামড়ার বেঁধে দেয়া দাম কিছুটা বাড়ানো হলেও তার সুফল বিক্রেতা পর্যায়ে পৌঁছেনি।

ঈদের দিন সকাল থেকেই শুরু হয় বৃষ্টি। এর মধ্যেই রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড়ে আনা হয় কোরবানি পশুর চামড়া। কিন্তু সংগ্রহকারী সংশ্লিষ্টরা ন্যায্যমূল্য পাননি। তাদের সবার মধ্যেই দাম নিয়ে ছিল ক্ষোভ। এখানে বড় আকারের কাঁচা চামড়ার বিক্রি মূল্য ছিল ৮০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে। আর মাঝারি গরুর চামড়া ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা এবং ছোট আকারের চামড়ার দাম দেয়া হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত।

রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড়ে মৌসুমি ব্যবসায়ী সাধন চন্দ্র দাস বলেন, ৭০০ টাকা করে প্রতি পিস চামড়া কিনে এখানে এসে দেখি, দাম দেয়া হচ্ছে ৬০০ টাকা। আরেক মৌসুমি ব্যবসায়ী মুকুল বলেন, বড় বড় চামড়া ৮০০ টাকার বেশি বলা হচ্ছে না। সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়ে দেয়া হয়েছে।

ঈদের আগে সরকার রাজধানীতে প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয় ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। কোনো গরুর চামড়া ২৫ বর্গফুট হলেও সরকার নির্ধারিত দামে তা হওয়ার কথা অন্তত ১২৫০ টাকা। কিন্তু কোনো চামড়ার দামই হাজার টাকা বলতে দেখা যায়নি আড়তদারদের। বরং ইচ্ছেমতো দামে বেচাকেনা হয় চামড়া। আর ছাগলের চামড়ার ক্রেতা ছিল না বললেই চলে। যদিও প্রতি পিসে এক কাপ চায়ের দামও দেয়া হয়নি। ধরা হয় ৫ থেকে ১০ টাকা।

রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকার চামড়া বিক্রি করতে আসেন কবিরুল। তিনি বলেন, বিগত বছরের মতো এবারো চামড়ার ন্যায্য দাম মিলছে না। বড় সাইজের গরুর প্রতি পিস চামড়া ৮০০ টাকা ও মাঝারি সাইজের গরুর প্রতি পিস চামড়া ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

এদিকে সায়েন্স ল্যাবরেটরির ফুটপাথের খোলা হাটে দেখা যায় বড় গরুর চামড়া ৬০০ টাকা, মাঝারি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। ছোট্ট ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। বেশ কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী মিনি ট্রাক বোঝাই করে কাঁচা চামড়া নিয়ে আসেন সায়েন্স ল্যাবের হাটে। তবে দাম কম বলায় বিক্রি না করে তারা পোস্তার দিকে রওনা দেন।

রাজধানীর সবচেয়ে পুরনো চামড়ার আড়ত লালবাগের পোস্তাতেও পরিস্থিতির ভিন্নতা ছিল না। অভিযোগ আছে, সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর করেনি কোনো আড়তদার। তারা বলেছেন, চামড়া প্রক্রিয়াকরণে প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বেশি, তাই বেশি দামে চামড়া কেনা যাচ্ছে না।

ছাগলের চামড়া মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। কদর নেই। একেবারে উচ্ছিষ্টে পরিণত হয়েছে। ঈদের দিন দেখা গেছে, এবারো ছাগলের চামড়া ছুঁয়েও দেখেন নাই আড়তদাররা। শুধু রাজধানীই নয়, সারা দেশে ছাগলের চামড়ার কোনো দামই পাননি বিক্রেতারা। এবারের কোরবানির ঈদে মাত্র ৫ টাকা বা তারও কম দামে প্রতি পিস ছাগলের চামড়া বিক্রি হতে দেখা গেছে। অনেক জায়গায় চামড়ার কোনো ক্রেতাই নেই।

রাজধানীর কল্যাণপুর থেকে ছাগলের ১০টি চামড়া নিয়ে সায়েন্সল্যাব এলাকায় আসেন একটি মাদ্রাসার শিক্ষকরা। একে একে ৬ জন ক্রেতার কাছে এই চামড়া নিয়ে যান তারা। কিন্তু তাদের কেউই কিনতে আগ্রহ দেখাননি। পরে এক ক্রেতা ১০টি চামড়ার জন্য মাত্র ৩০ টাকা দেয়ার প্রস্তাব করেন।

সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরীতে সংগ্রহ করা হয় পশুর চামড়া। মাদ্রাসা ও এতিমখানার চামড়াই এখানে বেশি আসে। দামের ক্ষেত্রে সেই মাদ্রাসা-এতিমখানা কর্তৃপক্ষেরও ছিল হতাশা।

ঢাকার তেজতুরী বাজার এলাকায় অবস্থিত রহমতে আল ইসলাম মিশন এতিমখানার সুপারিনটেনডেন্ট মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, এবছর ৯৫৮টি চামড়া শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করেছেন তারা। এসব চামড়া প্রতিটি ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৭৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন তারা। এবছর তেমন একটা আয় হয়নি। এই আয় এই প্রতিষ্ঠানটির মোট বার্ষিক খরচের তুলনায় খুবই নগণ্য বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা খুচরা পর্যায়ে বিক্ষিপ্তভাবে কেনাবেচা করেছে। মাদ্রাসা ও এতিমখানা থেকে যারা বিক্রি করছেন, তারা ন্যায্য দামই পাচ্ছেন।

আয়ের দিক থেকে দেশে তৈরি পোশাক খাতের পরে দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি পণ্য হলো চামড়া। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ১২৪ কোটি ৫২ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়া থেকে তৈরি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু চামড়া রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি ১৪ লাখ ডলারের। দেশে তৈরি চামড়ার জুতা বা পাদুকা রপ্তানি হয়েছে ৭৫ কোটি ৬২ লাখ ডলারের। আর অন্যান্য চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৩৩ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের। অন্যদিকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ১৪৪ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে গত মে মাস পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে ১১২ কোটি ডলারের চামড়া ও পণ্য।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, চামড়া শিল্পের দিকে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের নজর দিতে হবে। এই খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী বাড়াতে হবে।

https://mzamin.com/news.php?news=62657