এইচ এম আকতার: কুরবানির পশুর কাঁচা চামড়া এখন যেনো অস্বস্তি। কোনভাবেই কাউকে দিতে পারলেই যেন বাঁচলো কুরবানিদাতা। মাদরাসা কিংবা এতিমখানার কেউ এখন আর চামড়া নিতে চায় না। অনেক কুরবানিদাতা চামড়ার ক্রেতা খুঁজে পায়নি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে,চামড়ার মৌসুমি ক্রেতা নেই, এতিমখানা মাদরাসায় দান করে নিস্তার! ক্রেতার অভাবে রাজশাহীতে পুঁতে ফেলা হয় পশুর চামড়া।
আজ থেকে দশ বছর আগেই সরকার দলীয় লোকজনের বাহিরে কেউ চামড়া কেনার সাহস পায়নি। চামড়া কিনতে এক সময় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চলত প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে কোনো কোনো এলাকায় চামড়া কিনতে অধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মতো ঘটনাও ঘটতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আজ থেকে বিশ বছর আগেও প্রতিটি চামড়ার মূল্য ছিল ছোট চামড়া দুই হাজার মাঝারি চামড়া আড়াই হাজার এবং বড় চামড়া চাম ছিল ৩ হাজার। এই বিশ বছরে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে তিন গুণ চার গুণ। এমনকি চামড়াজাত পণ্যের দামও বেড়েছে কয়েকগুণ। চামড়াজাত পণ্যের কদরও বেড়েছে কয়েক গুণ। এখন এক জোড়া ভালো মানের জুতা (বাটা কিংবা এপেক্সের) কিনতে গেলে আড়াই/তিন হাজারের কমে পাওয়া যায় না। একটি গরুর চামড়া এরকম জুতা হয় প্রায় ২০/২৫ জোড়া। প্রশ্ন হলো কি কারণে কাচা চামড়ার দাম এত কমলো তার কোন সদুত্তর নেই কারো কাছে। গরুর চামড়াই যেখানে কদর নেই, ছাগলের চামড়ার খবর কে রাখে। ছাগলের চামড়া এখন মাটির নিচে পুতে রাখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ডোবা কিংবা পুকুরে ফেলে রাখতেও দেখা গেছে। এভাবেই আমাদের রফতানিকরণ পণ্য চামড়া প্রতি বছরই নষ্ট হচ্ছে। এনিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথাও নেই। সরকার যদি কাচা চামড়া রফতারি করার সুযোগ দিতে তাহলেও চামড়ার এতো দুর্দিন হতো না।
দশ বছর আগেও রফতানি পণ্যের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল আমাদের চামড়া। ইউরোপ আমেরিকায় আমাদের চামড়ার খুব কদর ছিল। কিন্তু দিনে দিনে আমরা সে বাজার হারিয়েছি। কিন্তু কি কারণে কিংবা এর দায় কার কেউ এক বাক্যে বলতে পারছে না। প্রশ্ন হলো চামড়ার সুদিন কি আর ফিরে আসবে না ।
গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় সন্ধ্যা পর্যন্ত মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের দেখা মিলেনি। ফলে অধিকাংশ রাজধানীবাসী ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় কুরবানির চামড়া বিভিন্ন মসজিদ মাদরাসায় দান করে দিয়েছেন। রাজধানীর প্রায় প্রতিটি এলাকার মাদরাসার ছাত্ররা ভ্যানে করে বিনামূল্যে দেয়া কোবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছেন। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মতিঝিল, মগবাজার, পুরনা পল্টন, মিরপুর ও মোহামম্মদপুর, শ্যামলী এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
সূত্র জানায়, টানা কয়েক বছর চামড়া কিনে বড় ধরনের লোকসানের কবলে পড়ায় এখন আর মৌসুমি ব্যবসায়ীদের চামড়া কিনতে দেখা যায় না। ফলে আগের কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও রাজধানীর কোথায়ও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের আনাগোনা নেই। কুরবানির ঈদের দিন রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় ঘুরে ও খবর নিয়ে মৌসুমি চামড়া ব্যাবসায়ীর তেমন সন্ধান পাওয়া যায়নি। ফলে কুরবানি কারা পশুর চামড়া সবাই নিকটবর্তী মসজিদ মাদরাসায় দান করেছেন। চামড়া বিনামূল্যে দিয়ে স্বস্তি আছেন। তাদের অভিমত চামড়ার কোনো ক্রেতা নেই, তাই মসজিদ মাদরাসায় দান না করলে এই চামড়া পচে নষ্ট হয়ে এলাকার পরিবেশ দূষিত করতো।
এ ব্যাপারে মতিঝিল এজিবি কলোনীর বাসিন্দা মোহাম্মদ গোলাম সরওয়ার বলেন, আমাদের এখানে এক বাউন্ডারির ভেতর ৬টি ভবনে ৪০০ বেশি পরিবার বসবাস করে। বরাবরের মতো এবারও কুরবানির পশুর চামড়া কিনতে কেউ আসেনি। আমরা আসার প্রত্যাশাও করিনি। বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার গরু চামড়া স্থানীয় গোলাপশাহ মাজার সংলগ্ন মসজিদে দান করে দিয়েছি। মাদরাসার ছাত্ররা এসে চামড়া নিয়ে গেছেন।
একই কথা বলেন কমলাপুরের বাসিন্দা মো. আবদুল আহাদ। তিনি বলেন, এখন আর কেউ চামড়া কিনতে আসে না। সবাই চামড়া নিকটবর্তী মসজিদ মাদরাসায় দান করে দিচ্ছেন। এটি এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, এমন একসময় ছিল যখন কুরবানির পশুর চামড়া কেনার জন্য মহল্লায় মহল্লায় তরুণদের মধ্যে রীতিমতো মারামারি হতো। কে কোন এলাকার নিয়ন্ত্রণ করে চামড়া কিনবে তা নিয়ে টেন্ডারবাজির মতো বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যেত। তখন চামড়ার দামও ছিল প্রচুর। প্রতিটি গরুর চামড়া আড়াই থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হতো। একই অভিযোগ এজিবি কলোনীর আহম্মদ আলী, কাউসার আহমেদ।
সরকার প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম নির্ধারন করে ঢাকা ৫৫ টাকা। কিন্তু একজনও বলতে পারবেনা এ দামে চামড়া বিক্রি করেছে। তাহলে কেন সরকার এ দাম নির্ধারন করলো। কার স্বার্থে চামড়া বিনা মূল্যে কিংবা নাম মাত্র মূল্যে ট্যানারি মালিকদের কাছে চলে যাচ্ছে। এর কোন উত্তর নেই।
অন্যদিকে মিরপুর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা আবুল কালাম আজাত বলেন, চামড়া বিক্রি করা হয় না। স্থানীয় মাদরাসায় দিয়ে দেই। মজার বিষয় শুনেছি কেউ একজন নাকি চামড়া কিনতে এসেছিল, দেড় লাখ টাকার গরুর চামড়া ৪০০ টাকা বলেছে। বিক্রি করা হয়নি, তা মসজিদে দান করা হবে।
এদিকে মিরপুর এলাকায় নিয়মিত চামড়া কিনতেন এমন একজন মৌসুমি ব্যবসায়ী শামীম ভুইয়া বলেন, গত দেড় দশক ধরে চামড়ার ব্যবসা মন্দা। এখন আর কেউ চামড়া কিনে লোকসানের ঝুঁকি নিতে চায় না। কারণ চামড়া কিনে এখন আর লাভ করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে চামড়ার পরিবর্তে অন্যখাতে বিনিযোগ করা লাভজনক।
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে রাস্তার মোড়ে এনে বিক্রি করার জন্য জমা করেছেন মাদরাসা শিক্ষার্থীরা। রাস্তার বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে কাঁচা চামড়া নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন মসজিদ মাদরাসায় কাঁচা চামড়ায় লবণ লাগিয়ে সংরক্ষণ হচ্ছে। পরে সেখান থেকে নিয়ে বিভিন্ন আড়তে বিক্রি করা হবে।
এদিকে মগবাজার এলাকার বাসিন্দা সালাম ফারুক বলেন, প্রতি বছর চামড়াজাত পণ্যের দাম বাড়লেও কমছে কুরবানির পশুর চামড়ার দাম। বিষয়টি খুবই রহস্যজনক। সরকারও সব সময় ব্যবসায়ীদের কথা শুনেই চামড়ার দাম নির্ধারণ করছে যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ)’র চেয়ারম্যান, মো. শাহীন আহমেদ বলেন,আমরা সাধারণত কুরবানির ঈদের দিন কাঁচা চামড়া কিনি না। ঈদের কয়েক দিন পর আমরা লবণযুক্ত চামড়া সংগ্রহ শুরু করি। তবে এই সময় বিভিন্ন
মসজিদ মাদরাসা থেকে কিছু কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হবে।
উল্লেখ্য, গত ২৫ জুন চামড়ার নতুন মূল্য নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। নতুন দাম অনুযায়ী ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৫৫ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। গত বছর এই দাম ছিল ৪৭ থেকে ৫২ টাকা। আর ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা।
