২ জুলাই ২০২৩, রবিবার

খেলাপিদের পোয়াবারো

ঋণখেলাপিরা সব সময়ই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছে। বরাবর খেলাপি হওয়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো পুরস্কৃতই করা হয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় খেলাপিদের পৃৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানী আইনের সংশোধনী আনা হয়েছে। জানা গেছে, আগে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হয়ে গেলে গোষ্ঠীটির অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পাওয়ার সুযোগ ছিল না। জাতীয় সংসদে বিদ্যমান আইন সংশোধন করে সেই সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। যা খেলাপিদের জন্য রীতিমত ‘পোয়াবারো’ বলেই মনে করা হচ্ছে। খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন আইনের ফলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়ে পড়বে এবং বাড়বে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এ কারণে সার্বিকভাবে ঝুঁকিতে পড়বে আমানতকারীদের স্বার্থ।

কয়েকজন ব্যাংক পরিচালক চলতি মাসে সরকারের উচ্চপর্যায়ে এক লিখিত প্রস্তাবে জানিয়েছিলেন, গ্রুপভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠান যাতে ঋণখেলাপের কারণে ঋণসুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়। তারা বলছিলেন, ঋণ ইচ্ছাকৃত খেলাপি না হলে বা যুক্তিসংগত কারণে ঋণখেলাপি হয়ে পড়লে সে ঋণ খেলাপি হিসেবে গণ্য হবে না। এসব প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংকগুলো। সংসদে আইনটি পাসের দিন সরকারি দলের একজন সংসদ সদস্য ২৭(ক) ধারার সংশোধনের প্রস্তাব আনেন। তিনি যেভাবে ওই নির্দিষ্ট ধারা সংশোধনের প্রস্তাব আনেন, অনেকটা একই রকমভাবে ব্যাংক পরিচালকেরা তাদের সংশোধনের প্রস্তাব সরকারের উচ্চপর্যায়ে জমা দিয়েছিলেন। জানা গেছে, সংসদে কণ্ঠ ভোটে এই প্রস্তাব পাস হয়ে যায়। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা অবশ্য এর প্রতিবাদে সংসদ থেকে বের হয়ে যান। আগের আইন অনুযায়ী, গ্রুপভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও খেলাপি হয়ে পড়ত। এর ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেশি ছিল।

অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন সংশোধনের ফলে সাময়িকভাবে খেলাপি ঋণ কমতে পারে। কারণ, একটি প্রতিষ্ঠানের কারণে অনেক সময় পুরো গ্রুপের ব্যবসা বন্ধ হয়ে পড়ছিল। তবে খেলাপি হয়ে পড়া গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিলে গ্রুপটি কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, সেটা দেখার ব্যাপার। এর আগে এই প্রক্রিয়ায় একটি গ্রুপকে অর্থায়ন করা হলেও সেটি ভালো করতে পারেনি। পাশাপাশি খেলাপি উদ্যোক্তাকে ঋণ দেওয়াটা বিদেশী ব্যাংক ও সহযোগী সংস্থাগুলো কীভাবে দেখবে, এটাও চিন্তার বিষয়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যারা ঋণখেলাপি, এখন তাদের যতটা সম্ভব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে খেলাপি ঋণ তো কমবেই না, বরং ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়ে পড়বে। ব্যাংকগুলোতে থাকা আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। উন্নয়নশীল দেশ গড়তে একটি শক্তিশালী ব্যাংক খাত প্রয়োজন। এই সিদ্ধান্ত তার অন্তরায়। আমানতকারীদের অর্থের এমন ব্যবহার হবে, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি-মার্চে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। ফলে গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় বাংলাদেশ ব্যাংক এখন খেলাপি ঋণ কমানোর পথ খুঁজছে, দিচ্ছে নানা নীতি ছাড়। এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্ত দিয়েছে। এখন বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের কম হলেও রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে তা ২০ শতাংশের বেশি। এ অবস্থায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংককে চলতি জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১২ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক চারটি হলো সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপিরা সবসময় নানাভাবেই পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছে। একশ্রেণির ব্যবসায়ী খেলাপি হওয়ার জন্যই ঋণ নিয়ে থাকেন বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশে বর্তমান খেলাপি ঋণের পরিমাণ অতীতের সকল সীমা অতিক্রম করেছে। এমতাবস্থায় বিদ্যমান আইনের সংশোধনী এনে খেলাপিদেরই নতুন করে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরে বড় ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যা অনাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত।

https://dailysangram.info/post/528685