২৮ জুন ২০২৩, বুধবার, ৮:৪৫

বাজারে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়ার আশঙ্কা

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মত

সরকারি চাকরিজীবীদের সাধারণভাবে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট হয় ৫ শতাংশ। এবার মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে যোগ হবে আরও ৫ শতাংশ। অল্প কিছু সংখ্যক মানুষের বেতন বাড়লে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে তা পুরো ১৭ কোটি জনগণকে ভোগাবে– মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা। আবার বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সব ক্ষেত্রে যখন ব্যয় সাশ্রয়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত রোববার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর বক্তব্য দেওয়ার সময় সরকারি কর্মচারীদের জন্য ৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়ার কথা জানান। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। শিগগির অর্থমন্ত্রীর কাছে একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হবে। এর পর তা অনুমোদনের জন্য যাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। জুলাইয়ের মধ্যেই সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হবে। কোনো কারণে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে প্রজ্ঞাপন জারি করতে কিছুটা দেরি হলেও জুলাই থেকে তা কার্যকর হবে।

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮১৮। বাড়তি ৫ শতাংশের জন্য সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হবে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। বাড়তি প্রণোদনা এককালীন নয়, বরং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রতি মাসের বেতনের সঙ্গেই যোগ হবে। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার সব কর্মচারীর ক্ষেত্রেই বেতন বৃদ্ধি প্রযোজ্য হবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সংগত কারণেই সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় সাশ্রয়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ সময় ঢালাওভাবে সব সরকারি চাকরিজীবীর বেতন বৃদ্ধি যৌক্তিক নয়। কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতেও কর্মকর্তারা আর্থিক সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম বলেই মনে হয়। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির বিশেষ পরিস্থিতিতে এ প্রণোদনার বিষয়টি শুধু নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের জন্য বিবেচনা করা যেত।

তিনি বলেন, সরকারি হিসাবেই বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম, টাকার অবমূল্যায়নের পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটিই মূল্যস্ফীতি বাড়ার অন্যতম কারণ। বিশ্বের প্রতিটি দেশের কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অতিরিক্ত মুনাফার আশায় বাজার অস্থিতিশীল করতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেসব দেশের সরকার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখে। আর বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী জাতীয় সংসদে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন, অধিক সংকটের শঙ্কায় সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, গুটি কয়েক অসাধু ব্যবসায়ীর হাতে জিম্মি সরকার। বাজার নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী না হয়ে সরকার অল্প সংখ্যক মানুষের বেতন বাড়াচ্ছে। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি আরও বাড়াবে, যা দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষকে ভোগাবে।

বিদ্যমান বেতন কাঠামো অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতার ২০টি ধাপ (গ্রেড) রয়েছে। সর্বোচ্চ বা প্রথম ধাপের মূল বেতন নির্ধারিত ৭৮ হাজার টাকা। আর ২০তম ধাপের মূল বেতন ৮ হাজার ২৫০ টাকা। বার্ষিক স্বাভাবিক বেতন বৃদ্ধি বাদ দিলে প্রথম ধাপের সরকারি কর্মচারী এবার ৫ শতাংশ প্রণোদনা হিসেবে পাবেন ৩ হাজার ৯০০ টাকা। আর শেষ ধাপের সরকারি কর্মচারী পাবেন ৪১২ টাকা ৫০ পয়সা।

এ প্রসঙ্গে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান সমকালকে বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট। বেতন বৃদ্ধির ফলে খুব অল্প পরিমাণ মানুষ হয়তো কিছুটা স্বস্তি পাবে। কিন্তু বাকি জনগণের জন্য কী হবে? বাজারে তো সবাই যায়। পাঁচ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি হয়তো খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। তার পরও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিকে কিছুটা হলেও উস্কে দিতে পারে। তখন সাধারণ মানুষ আরও চাপে পড়বে।

তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত হবে দেশের সব মানুষের জন্য মূল্যস্ফীতি কমানোর ব্যবস্থা করা। কিন্তু বাজাট ও মুদ্রানীতিতে এ জন্য খুব বেশি পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এখন পর্যন্ত বাজার নিয়ন্ত্রণেও সরকারের তেমন উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। এ বিষয়গুলোতে সরকারকে নজর দিতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিত্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও শুল্ক-কর ছাড়ে বিষয়গুলোও পুনর্বিবেচনায় আনতে হবে।

https://samakal.com/economics/article/2306180633