২৮ জুন ২০২৩, বুধবার, ৮:৪১

ছাগলের চামড়া কেন মূল্যহীন

বিশ্ববাজারে ছাগলের চামড়ার বিপুল চাহিদা থাকার পরও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই পণ্য দেশে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে

স্থানীয় বাজারে পশুর চামড়ার একটি লেডিস হাতব্যাগের দাম ন্যূনতম দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। এই ব্যাগ তৈরিতে লাগে মাত্র তিন ফুট চামড়া। এই চামড়া ট্যানারি থেকে উদ্যোক্তারা সংগ্রহ করেন প্রতি বর্গফুট ১০০ থেকে ২৫০ টাকায়। অথচ প্রতিটি ছাগলের চামড়ার দাম ১০০ টাকাও পান না এর মালিকরা।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, চামড়ার বৈশ্বিক চাহিদা বর্তমানে কিছুটা কম থাকলেও চামড়াজাত পণ্যের দাম কিন্তু কম নয়। দেশে প্রতিবছর দাম বাড়ছে। বাংলাদেশের চামড়া বিশ্বমানের হলেও সেই চামড়ার কদর নেই। বিশেষ করে ছাগলের চামড়া একেবারে উচ্ছিষ্টে পরিণত হয়েছে।

অথচ ছাগলের চামড়া হাল ফ্যাশনের পণ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর চামড়া বেশ কোমল হওয়ায় লেডিস ব্যাগ, জ্যাকেটের উপকরণ, মানিব্যাগ, বেল্টসহ নানা আনুষঙ্গিক পণ্য বানাতে বিশাল চাহিদা রয়েছে। এর বড় বাজার যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে। এই বাজার দখল করে আছে চীন ও ভারত।

রাজধানীর শান্তিবাগের মাংস ব্যবসায়ী আবদুল মতিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ছাগলের চামড়ার দাম নেই। প্রায় ফেলে দিতে হয়। বিক্রি করলে সেই চামড়ায় লবণ দিতে হয় ১৫ থেকে ২০ টাকার। আর বিক্রি হয় ১০ থেকে ১৫ টাকায়। অর্থাৎ লবণের দামই মেলে না।

তা ছাড়া দুই মণ ওজনের গরুর চামড়াই বিক্রি হয় ২০০ টাকায়।’
অন্যদিকে মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব মো. রবিউল আলম বলেন, আট থেকে ১০ কেজি মাংস হয় এমন একটি ছাগল থেকে পাঁচ বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। মাংসের দোকান বা বাজার থেকে কাঁচা চামড়ার ব্যাপারি এই চামড়া কেনেন ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। ব্যাপারি লবণ যুক্ত করে ওই চামড়া আড়তে বিক্রি করেন মানভেদে ২০০ থেকে ৩০০ টাকায়। তবে কোনো কোনো সময় কারিগরি দক্ষতার অভাবে তা আরো কম দামেও বিক্রি হয়। আড়ত থেকে চামড়া যায় ট্যানারিতে।

পণ্য তৈরির জন্য ট্যানারি থেকে চামড়া সংগ্রহ করেন চামড়াজাত শিল্পোদ্যোক্তারা। তেমনই একজন লেদারিনা প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তসলিমা মিজি। সাভারের হেমায়েতপুরে তাঁর প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫০ জন কর্মী চামড়ার ব্যাগ, ওয়ালেট ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন, বাজারজাত ও রপ্তানি করেন।

তসলিমা মিজি কালের কণ্ঠকে জানান, একটি ব্যাগ বানাতে তিন বর্গফুট চামড়া লাগে। প্রতি বর্গফুটের দাম ১০০ থেকে ২৫০ টাকা। ট্যানারি থেকে এসব চামড়া সংগ্রহ করেন। একটি ব্যাগ তৈরিতে প্রায় ৮০ শতাংশ চামড়া লাগে। অন্যান্য পণ্য লাগে বাকি ২০ শতাংশ।

তসলিমা মিজি বলেন, বৈশ্বিক মন্দা, পরিপালনীয় মানদণ্ড বা শর্ত না মানা, সিনথেটিক চামড়ার ব্যবহার বৃদ্ধি, অদক্ষ শ্রমিক ও বিনিয়োগে আর্থিক সংকটের ফলে দেশের মূল্যবান চামড়াসম্পদ কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

এ ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে জানতে কথা হয় অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, চামড়াশিল্প খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী বাড়াতে হবে। বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের অব্যবস্থাপনা থেকে উদ্ধার করে ৩০ থেকে ৪০টি বিদেশি বিনিয়োগকারীর মাধ্যমে এই খাতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আনা গেলে দেশের চামড়া খাতে আমূল পরিবর্তন আসবে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) সামর্থ্য না থাকলেও সাভারে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) তৈরির দায়িত্ব তাদের দেওয়া হয়। ফলে দেশের দ্বিতীয় বড় রপ্তানি আয়ের চামড়া খাত হুমকির মুখে পড়েছে।

লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রতিবছর ঈদুল আজহায় পশু কোরবানির পর প্রায় এক কোটি ২০ লাখ চামড়া সংগ্রহ হয়। এর মধ্যে ছাগলের চামড়া ২০ থেকে ৩০ লাখ। যথাযথ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও কমপ্লায়েন্স না থাকায় অনেক চামড়া নষ্ট হয়। স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল পাওয়ায় লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডাব্লিউজি) সনদ পাওয়া গেলে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য শিল্প বহু বিলিয়ন ডলারের শিল্পে পরিণত হওয়ার সক্ষমতা আছে।

একই কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির পরিচালক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে ছাগলের চামড়ার বিপুল চাহিদা থাকার পরও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই পণ্য দেশে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। দেশে কমপ্লায়েন্সের অভাবে বর্তমানে বৈশ্বিক বাজারে এই চাহিদা পূরণ করছে ভারত ও চীন।

বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, বৈশ্বিক চামড়া বাজার ৪২০ বিলিয়ন ডলারের। ২০৩২ সালে এর বাজার হবে ৭৩৫ বিলিয়ন ডলারের। প্রায় ৬ শতাংশ হারে বৈশ্বিক এই বাজার বাড়ছে। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করতে চায়, যা বর্তমানে ১০০ কোটি ডলার (এক বিলিয়ন)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম আবু ইউসুফ বলেন, যথাযথ কমপ্লায়েন্সের অভাবে বিশ্ববাজারে চামড়ার দাম কমেছে ৪০ শতাংশ। পাশাপাশি স্থানীয় বাজারেও চামড়াজাত পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এসব সংকট সমাধানে শিল্প মন্ত্রণালয়, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং শ্রম মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এসব নিশ্চিত করা গেলে ২০৩০ সালে এক হাজার কোটি ডলার রপ্তানি আয় করা সম্ভব।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/06/28/1294061