২৮ জুন ২০২৩, বুধবার, ৮:২০

কচ্ছপের গতি রেলের প্রকল্পে

অনিয়মে রাষ্ট্রের ক্ষতি ১৮.২৬ কোটি টাকা

চার বছরের প্রকল্প ৫ বছরে ৪০ শতাংশ অগ্রগতি

সঠিকভাবে সমীক্ষা না করা এবং অদক্ষ জনবলের কারণে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ হচ্ছে না। উল্টোর মেয়াদ ও খরচ বাড়ছে। মধুখালী থেকে কামারখালী এবং কামারখালী থেকে মাগুরা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণে কাজ কচ্ছপের গতিতে চলছে। আর এই প্রকল্পে ভ্যাট ও কর বাবদ রাজস্বসংক্রান্ত আর্থিক অনিয়মের কারণে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে ১৮ কোটি ২৬ লাখ টাকার বেশি বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। এক হাজার ২০২ কোটি ৫০ লাখ টাকায় ৪ বছরের অনুমোদিত প্রকল্প ৫ বছরে কাজ হয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশ। বর্ধিত মেয়াদেও শেষ না হওয়ার আশঙ্কা পরিকল্পনা কমিশনের। ফলে সরকারের লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। প্রকল্পটি অনুমোদনের পর পরামর্শক নিয়োগ করতেই এক বছর এবং কাজের জন্য ঠিকাদারের সাথে চুক্তি করে দুই বছর সময় অতিক্রান্ত। চার বছরের এই প্রকল্পটি এখন ৬ বছরে উন্নীত করা হচ্ছে বলে রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। জমি অধিগ্রহণজনিত জটিলতা, এলাকার বাস্তবতা এবং সর্বোপরি করোনার প্রদুর্ভাবের কারণে কাজ সময়মতো শুরু করা যায়নি। কাজ শুরু হয়েছে ২০২১ সালের ২৩ মে।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, প্রায় ৪৬ বছর আগে ফরিদপুর মধুখালী থেকে কামারখালী পর্যন্ত রেলপথ ছিল। কিন্তু এটা এখন আর ব্যবহার হয় না। তবে কামারখালী থেকে মাগুরা পর্যন্ত কোনো রেলপথ নেই। তাই মধুখালী থেকে কামারখালী পর্যন্ত বিদ্যমান রেলপথটি সংস্কার করে ব্রডগেজ এবং কামারখালী থেকে মাগুরা পর্যন্ত নতুন রেললাইন করার জন্য এক হাজার ২০২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প ২০১৮ সালের মে মাসে অনুমোদন দেয়া হয়। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল প্রকল্পটি সমাপ্ত করার জন্য অনুমোদিত মেয়াদ ছিল।

প্রকল্পের আওতায় কাজগুলো হলো, ১৯.৯০ কিলোমিটার মেইন লাইন নির্মাণ। কামারখালী ও মাগুরা স্টেশন ইয়ার্ডে ৪.৯ কিলোমিটার লুপ লাইন নির্মাণ করা। দু’টি নতুন স্টেশন নির্মাণ করা। ২৭টি মাইনর সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করা। চন্দনা ও গড়াই দু’টি মেজর সেতু নির্মাণ করা। একটি আন্ডারপাস এবং এক হাজার ৬৮০ মিটার ভায়াডাক্ট নির্মাণ করা। সিগন্যালিং ও ইলেকট্রিক্যাল কাজ করা।

আর্থিক অনিয়মগুলো হলো, মোবিলাইজেশন অগ্রীম হতে ভ্যাট কর্তন না করায় রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ৬ কোটি ৬২ লাখ ৪ হাজার ৯৪৪ টাকা। এখানে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট কাটা হয়নি। এখানে মুসক আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। বীমা না করার কারণে ভ্যাট বাবদ ক্ষতি ৭ কোটি ২৮ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে এই বীমা না করার কারণে রাজস্ব ক্ষতি সরকারের। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদার চুক্তিকালে কোনো বীমাপত্র দাখিল করেনি।

অন্য দিকে জয়েনভেঞ্চার ফার্মের টিআইন নাম্বার না থাকায় উৎসে কর কর্তন না করায় ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের ৩ কোটি ৮২ লাখ ৬২ হাজার টাকা রাজস্ব ক্ষতি। আর পরামর্শক সরবরাহ সেবা মূল্যের ওপর আয়কর আরোপ না করে ইনক্লুডিং ট্যাক্স ও ভ্যাট মূল্যের ওপর আয়কর আরোপ করায় সরকারের ক্ষতি ২৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা, যা আয়কর আদেশ লঙ্ঘন করা হয়েছে।
এ ছাড়া বৈদ্যুতিক লাইন বা খুঁটি স্থানান্তর কাজের জন্য ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকে অগ্রীম ২ কোটি ৪২ লাখ ১৮ হাজার ৭৮৮ টাকা প্রদান করা হয়। কিন্তু ভ্যাট বাবদ ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে ২৭ লাখ ৩৬ হাজার ৪৯১ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যা সরকারের রাজস্ব ক্ষতি।

সংশ্লিষ্টদের থেকে জানা গেছে, মূলত দু’টি প্যাকেজ ডব্লিউডি-১ এবং ডব্লিউডি-২-এর মাধ্যমে বাস্তবায়নের সংস্থান রয়েছে। ১নং প্যাকেজের আওতায় কার্যক্রমগুলো হলো ২৩.৯০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ, স্টেশন বিল্ডিং, প্ল্যাটফর্ম, প্লাটফর্ম শেড, অ্যাপ্রোচ রোড ও কার পার্কিং এরিয়া, আরসিসি বক্স কালভার্ট, লেভেল জিং গেট, বাঁধ, ব্যাংক সুরক্ষা প্রাচীর, বাউন্ডারি ওয়াল, ব্যালাস্ট ওয়াল, কার্ভ পোস্ট, কে এম পোস্ট, ক্রিপ পোস্ট, সিগন্যালিং, টেলিকম, ইলেকট্রিক ওয়ার্কস এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ। প্যাকেজ-১ এর আওতায় মে ২০২৩ পর্যন্ত এ প্যাকেজের ভৌত অগ্রগতি ২৭.৭০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ২৭ শতাংশ।
আর প্যাকেজের-২ আওতায় কার্যক্রমসমূহ হলো ভায়াডাক্টসহ দু’টি মেজর ব্রিজ নির্মাণ করা। মে ২০২৩ পর্যন্ত এ প্যাকেজের ভৌত অগ্রগতি ২৮.৫০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ২৮ শতাংশ। সার্বিকভাবে প্যাকেজ ২টির ভৌত অগ্রগতি ২৮.৫০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ২৭.৫০ শতাংশ। মে ২০২৩ পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত ভৌত অগ্রগতি ৪০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৩৬.১০ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম।

বাস্তব পর্যালোচনায় এস এ কনসাল্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের মাঠপর্যায়ের তথ্য বলছে, প্রকল্পের দুর্বলতা হলো, প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ সময়মতো না হওয়া। জমি অধিগ্রহণ সময়মতো সম্পন্ন না হওয়া। প্রকল্পের পিআইসি ও পিএসসি সভা যথাসময়ে না হওয়া। ডিপিপির বিশেষ সংশোধন সময়মতো না হওয়া। দ্রব্যমূল্যের মূল্যমান সমন্বয় দ্রুত না করা। বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত বাস্তবায়ন না করা। অডিট নিষ্পত্তির ধীরগতি। বিভাগ ও মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়মিত মনিটরিং না করা।
আর প্রকল্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি এবং অতিবৃষ্টিতে রাস্তা চলাচলের অনুপোযোগী হওয়া। কোভিড-১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাব প্রকল্পের অগ্রগতি ব্যাহত হওয়া। রেললাইন সম্পর্কিত দুর্ঘটনা ঘটা। বর্জ্য ও ময়লায় আশপাশের খাল-নালা ভরে গিয়ে পরিবেশ দূষিত হওয়া। বাস্তবায়নের গতি মন্থর হওয়ায় প্রকল্পের সময় বৃদ্ধি এবং বাস্তবায়ন খরচ বৃদ্ধি। চন্দনা নদীতে ব্রিজ ফাউন্ডেশন সমস্যা। বিভিন্ন বিভাগের অধীনে বিপুলসংখ্যক বৈদ্যুতিক খুঁটি প্রতিস্থাপন। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব।

 

 

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/758671