২৮ জুন ২০২৩, বুধবার, ৮:১৫

কারাবন্দী শীর্ষ নেতাদের মুক্তি মেলেনি ঈদের আগেও

দীর্ঘ দিন ধরে কারাবন্দী বিরোধী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের মুক্তি মেলেনি কোরবানির ঈদের আগেও। কয়েকজন শীর্ষ নেতা উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পর তাদেরকে একাধিকবার গায়েবি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। জামিন পেয়ে মুক্তি পাওয়ার কথা থাকলেও পুলিশ তাদেরকে জেল গেট থেকে পুনরায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারারুদ্ধ করে রেখেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার উচ্চ আদালত থেকে একাধিক মামলায় জামিন পান। কিন্তু তাকে পুনরায় গ্রেফতার দেখানোয় মুক্তি মেলেনি। এ ছাড়াও জামায়াত ও বিএনপির কয়েকডজন শীর্ষ নেতা এবং ইসলামী দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতা ও বরেন্য আলেম কারাগারে বন্দী। যাদেরকে ভিত্তিহীন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে বছরের পর বছর বন্দী করে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ঈদের আগে তাদের মুক্তির আশা করেছিলেন স্বজনেরা। তারা মুক্তি না পাওয়ায় প্রিয়জনকে ছাড়া ম্লান হচ্ছে পরিবারের ঈদের আনন্দ।

জানা গেছে, শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নেয়া হয়। এরপর তাদের স্থান হয় কারাগারে। কিন্তু চার দেয়ালের মাঝে বন্দী থাকায় প্রাপ্য মর্যাদা টুকুও তারা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ আছে। শীর্ষ নেতাদেরকে কারাগারে ডিভিশন পেতে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে স্বজনদের। অনেকেই কারাগারে ডিভিশন পাননি। স্বজনদের অভিযোগ- গ্রেফতার নেতাদের মধ্যে কয়েকজন আগে থেকেই গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। তারা কারাগারে যাওয়ার আগে থেকেই জটিল রোগের কারণে নিয়মিত চিকিৎসকদের পরামর্শে চলতেন। কারাগারে যাওয়ার পর তারা উন্নত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এদিকে নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান সাত মাসের বেশি সময় ধরে কারাগাগারে রয়েছেন। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার প্রায় দুই বছর ধরে কারাবন্দী আছেন। সম্প্রতি তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পর তিনবার গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ। ২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ভাটারা থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাকে একাধিক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়া হয়। তখন থেকে কারাগারে আটক আছেন এই নেতা। এ ছাড়াও কারাগারে বন্দী আছেন- জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সাবেক এমপি মাওলানা আনম শামসুল ইসলাম, সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর সেলিম উদ্দিন, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরীসহ আরো কয়েকজন। এছাড়াও দীর্ঘ দিন ধরে কারাবন্দী আছেন বেশ কয়েকজন শীর্ষ আলেম-উলামা।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারকে মুক্তির বিষয়ে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবীরা এক সাংবাদিক সম্মেলন করেন। সেখানে এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেছেন, অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার সকল মামলায় জামিনে রয়েছে। তার বিরুদ্ধে এই মুহুর্তে কোন মামলা নেই। কারা কর্তৃপক্ষ কোনো অবস্থাতেই তাকে আটক রাখতে পারেন না। দেশের সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অবিলম্বে তাকে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কোন আইন বলে তাকে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বাংলাদেশ ল’ ইয়ার্স কাউন্সিলের সেক্রেটারি জেনারেল এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ। সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার ২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সংগঠনের একটি ঘরোয়া বৈঠক থেকে গ্রেফতার হন। পরদিন ৭ সেপ্টেম্বর তাঁকে আদালতে হাজির করে প্রথমে ৪ দিন ও পরে আরো ২ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। তিনি ৮ নভেম্বর উচ্চ আদালত থেকে জামিন প্রাপ্ত হন। সরকার তার জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিল বিভাগ তার জামিন বহাল রাখেন। ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি জেল থেকে বের হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে আরেকটি মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে ৩ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি উচ্চ আদালত থেকে ফের জামিন লাভ করেন। সরকার পুনরায় তার জামিন বাতিলের জন্য আপিল করলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সরকারের আবেদন খারিজ করে দেন। তিনি জেলখানা থেকে বের হওয়ার পূর্বে আবারো তার বিরুদ্ধে দুদকের কথিত অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২২ সালের ৩০ মে একটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। উক্ত মামলায়ও তিনি এ বছরের ৩০ মার্চ হাইকোর্ট থেকে জামিন প্রাপ্ত হন। এবারো সরকার পক্ষ আপিল করলে চেম্বার জজ তা খারিজ করে দেন।

তিনি পরপর তিনবার দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে জামিন লাভ করে সর্বশেষ পবিত্র মাহে রমাদানে কারাগার থেকে বের হওয়ার প্রাক্কালে ১৬ এপ্রিল ২০২৩ পবিত্র ঈদুল ফিতরের পূর্ব মুহূর্তে আবারো তাকে একটি মিথ্যা মামলায় যুক্ত করে গ্রেফতার দেখানোর আবেদন করা হয়। ২৭ এপ্রিল তাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত পরবর্তীতে শুনানী শেষে ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তিনি বলেন, ২৯ মে তিনি উচ্চ আদালত থেকে আবারো জামিনপ্রাপ্ত হন। এর মাধ্যমে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে সকল মামলায় জামিন প্রাপ্ত হলেন। ১৩ জুন তার জামিননামা দাখিল করা হয়। ঠিক এই মুহূর্তে তার বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা নেই। সুতরাং কারা কর্তৃপক্ষ কোনো অবস্থাতেই তাকে আটক রাখতে পারেন না। জামিননামা দাখিল হওয়া মাত্র কারাকর্তৃপক্ষ তাঁকে মুক্ত করে দিবেন, এটাই স্বাভাবিক। অধিকন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত ২০২২ সালের ১৭ মে তাকে গ্রেফতার ও হয়রানি না করার নির্দেশ দিয়েছেন। আদালতের এই নির্দেশনা থাকার পর তাঁকে মুক্তি না দেয়া কিংবা গ্রেফতার বা হয়রানি করা সম্পূর্ণ আদালত অবমাননার শামিল।

এদিকে কারাগারে থাকা একজন বিএনপি নেতার স্ত্রী বলেন, তার স্বামী সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় কর্মী ও বিএনপির সম্ভাব্য এমপি প্রার্থী। গত চার মাস ধরে পেন্ডিং মামলা দিয়ে কারাগারে আটক করে রেখেছে সরকার। কয়েকবার আদালতে জামিন পেলেও নতুন করে মামলা দিয়ে কারাগারে আটকে রাখা হচ্ছে। সরকারের লোকজন আমাদের নানাভাবে চাপে রাখছেন। আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে সরকারের অধীনে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্যও বলেছেন অনেকে। তবে রাজি না হওয়ায় মুক্তি মিলছে না। জানা যায়, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন রাজধানীতে এমন শতাধিক শীর্ষ বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী কারাগারে রয়েছেন। কারান্তরীণ নেতাদের মধ্যে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি’র সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্না, সাবেক সহ-সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের আহ্বায়ক গোলাম মাওলা শাহীন, বিএনপি’র নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম, ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান মোসাব্বিরসহ আরও অনেকে রয়েছেন। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনে যারাই সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন তাদের টার্গেট করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তারা যেন সহজভাবে জামিনে মুক্তিলাভ করতে না পারেন সেজন্য একের পর এক পেন্ডিং মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, বিএনপি’র আন্দোলন দেখে সরকার দিশাহারা। এজন্য বিরোধী শক্তিকে দমন করতে নানাভাবে পাঁয়তারা করছে ক্ষমতাসীনরা। আমাদের শীর্ষ নেতাদের অন্যায়ভাবে সাজা দিচ্ছে। গায়েবি ও পেন্ডিং মামলা দিয়ে সক্রিয় নেতাদেরকে কারাগারে নেয়া হচ্ছে। যেসব শীর্ষ নেতাকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মুক্তি মিলছে না। আদালত জামিন দিলেও নতুন মামলা দেখিয়ে ফের কারাগারে বন্দী রাখা হচ্ছে। বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেপ্তারের পর তাদের আর ছাড়া হচ্ছে না। জামিন হলেও আরেকটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে।

https://dailysangram.info/post/528630