২৭ জুন ২০২৩, মঙ্গলবার, ৭:১৬

লবণের দাম চড়া, চামড়া নিয়ে এবারো শঙ্কা

দেশে পশুর চামড়া সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মৌসুম কোরবানির ঈদ। প্রতিবছর উৎপাদিত কাঁচা চামড়ার প্রায় অর্ধেকই আসে ঈদুল আজহায়। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর ১ কোটি ৩০ লাখ পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত আছে। কোরবানি হতে পারে ৮৫ লাখ পশু, যা চাহিদার চেয়েও ২০ থেকে ২১ লাখ বেশি। এই সময়ে চামড়া সংরক্ষণে কাঁচামাল হিসেবে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টন লবণের চাহিদা থাকে। কিন্তু চলতি মৌসুমে রেকর্ড উৎপাদনের পরেও লবণের ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে চামড়া সংগ্রহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ৬১ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হলেও বাজারে এর প্রভাব নেই। বরং উল্টো লবণের দাম বস্তাপ্রতি বেড়েছে প্রায় ৩০০ টাকা।

চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট প্রতিবছর কোরবানির আগে লবণের দাম বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে পুরো চামড়ার বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মৌসুমি ছোট ব্যবসায়ীরা।

কোরবানির আগে লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ার পেছনে সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। এভাবে লবণের দাম বাড়লে এর প্রভাব পড়বে কাঁচা চামড়ার ওপর। ফলে কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্য দাম অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

সূত্র জানায়, নানা অজুহাতে প্রতি বছর কোরবানির ঈদে ট্যানারি মালিকরা পশুর চামড়া এক রকম পানির দামে ক্রয় করে থাকেন। এতে বঞ্চিত হয় অসহায় গরিব মানুষ। এবারো সস্তায় চামড়া কিনে গরিবকে ঠকিয়ে বাণিজ্য হবে বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ। আবার কম দামে চামড়া কিনলেও দেশের ভোক্তাকে চামড়ার জুতা-স্যান্ডেল কিনতে হয় চড়া দামে।

জানা গেছে, বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫৭০ টাকায়। কিন্তু লবণের প্রধান পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের মাঝির ঘাটে প্রতিবস্তা ক্রুড লবণ বিক্রি হচ্ছে ১১৫০ থেকে ১২৫০ টাকায়; যা কয়েক সপ্তাহ আগেও ১১০০ টাকার নিচে বিক্রি হয়েছে। অথচ গত বছর কোরবানির ঈদের আগে ক্রুড লবণের দাম ছিল সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৪৫০ টাকা বেড়েছে ক্রুড লবণের দাম।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্যমতে, শুধুমাত্র চামড়াখাতে গত অর্থবছরে ৩ লাখ ৩২ হাজার টন লবণের চাহিদা ছিল। এবছর চাহিদা বেড়ে তা দাঁড়াবে ৩ লাখ ৪১ হাজার টনে।

চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিটি গরু বা মহিষের চামড়া সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করতে ৮ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত লবণের প্রয়োজন। পরিবহন, শ্রমিক মজুরি, লবণের মূল্যসহ প্রতিটি চামড়া সংরক্ষণে গত বছর ১৮০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়েছে। কিন্তু লবণ ও অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবারে প্রতিটি চামড়া সংরক্ষণে খরচ হবে ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা।

বিসিক তথ্যমতে, দেশে লবণের চাহিদা ২৪ লাখ টন। সম্প্রতি শেষ হওয়া মৌসুমে ২৩ লাখ টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টন এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছর ছিল ১৬ লাখ ৫৭ হাজার টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। তবে বাড়তি উৎপাদন সত্ত্বেও আসন্ন ঈদুল আজহাকে ঘিরে বেড়েই চলেছে লবণের বাজার।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, আড়ত পর্যন্ত পৌঁছার আগে লবণের দাম পড়তো কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ১৬ টাকা। সেই লবণ এখন ১৯ থেকে ২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। লবণ সিন্ডিকেটে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তারা।

বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, মৌসুম শুরুর আগেই লবণের দাম বেড়ে যাওয়া চামড়া ব্যবসায়ীদের চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এভাবে দাম বাড়লে এর প্রভাব পড়বে কাঁচা চামড়ার ওপর।

এদিকে দেশে সবকিছুর দাম বাড়লেও কেবল কোরবানির পশুর দাম কমছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে দেশে কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য অনেক কমেছে। দেখা যাচ্ছে, গত ১০ বছরে প্রতি বর্গফুটে গরুর চামড়ার মূল্য কমেছে ৩৮ টাকা, খাসির চামড়ার মূল্য কমেছে ৩২ থেকে ৩৫ টাকা এবং বকরির চামড়ার মূল্য কমেছে ২৮ থেকে ৩১ টাকা। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১০ বছর আগে ২০১৩ সালেও ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৮৫-৯০ টাকা, আর ঢাকার বাইরে ৭৫-৮০ টাকায় কেনা হয়। সে বছর খাসির চামড়ার দর প্রতি বর্গফুট ৫০-৫৫ টাকা এবং বকরির চামড়া ৪০-৪৫ টাকা নির্ধারণ হয়। এ ছাড়া মহিষের চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় প্রতি বর্গফুট ৪০-৪৫ টাকা। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে গরুর চামড়ার মূল্য কমিয়ে ধরা হয় ৭০-৭৫ টাকা, খাসির চামড়া ৪০-৪৫ টাকা এবং বকরির চামড়ার মূল্য ছিল ৩৫-৪০ টাকা। ২০১৫ সালে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দর আরও কমিয়ে ৫০-৫৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়, খাসির চামড়া ২০-২৫ টাকা এবং বকরির চামড়ার মূল্য ছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা। ২০১৬ সালে ঢাকায় কোরবানির গরুর লবণযুক্ত চামড়ার দাম ধরা হয়েছে প্রতি বর্গফুট সর্বোচ্চ ৫০-৫৫ টাকা, খাসির ৩০-৩৫ টাকা এবং বকরির চামড়ার মূল্য ছিল ২০-২৫ টাকা। ২০১৭ সালে কমিয়ে গরুর চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৪৫-৫০ এবং খাসির চামড়া ২০-২২ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৫-২০ টাকা। পরের দুই বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে গরুর চামড়ার মূল্য ছিল ৪৫-৫০ টাকা, খাসির ১৮-২০ টাকা এবং বকরির ১৫-১৭ টাকা। ২০১৯ সালে গরুর চামড়ার মূল্য ছিল ৪৫-৫০ টাকা, খাসির চামড়ার মূল্য রাখা হয় ১৮-২০ টাকা এবং বকরির চামড়ার মূল্য ১৩-১৫ টাকা।

২০২০ সালে গরুর চামড়ার মূল্য প্রতি বর্গফুটে নির্ধারণ করা হয় ৩৫-৪০ টাকা, খাসির চামড়ার মূল্য ১৩-১৫ টাকা এবং বকরির চামড়া ১০-১২ টাকা। ২০২১ সালে গরুর চামড়ার মূল্য হয় ৪০-৪৫ টাকা, খাসির ১৫-১৭ টাকা এবং খাসির ১২ থেকে ১৪ টাকা। গত ২০২২ সালে গরুর চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৪৭-৫২ টাকা, খাসির ১৮-২০ টাকা এবং বকরির ১২-১৪ টাকা। এদিকে গতকাল রোববার ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার মূল্য নির্ধারণ বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, এ বছর সারা দেশে গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। তবে ঢাকায় এই চামড়া বিক্রি হবে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। এ ছাড়া সারা দেশে খাসি ও ছাগলের চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরি ও ছাগলের চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা দরে।

এদিকে চামড়ার দাম কমলেও জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগের মতো চামড়াজাত পণ্যের মূল্য বেশ চড়া। বিটিএ সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, একটি গরুর চামড়ার সাইজ প্রায় ২২ বর্গফুট। এমন লবণবিহীন কাঁচা চামড়ার মূল্য ৮৫০ টাকা। অন্যান্য প্রসেসিংয়ে ব্যয় হয় ১৯০০ টাকা। একটি পাকা চামড়ার মূল্য দাঁড়ায় ২৭৫০ টাকা। এরপর এটি দিয়ে ১০ জোড়া উন্নত মানের জুতা তৈরি করা সম্ভব। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৫০ হাজার টাকা।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে বাংলাদেশ ১.১২ বিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করেছে। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ০.৪২ শতাংশ বেড়েছে। ইপিবি’র তথ্যমতে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে দেশ থেকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ১২ হাজার ৯৮ কোটি ৫৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। এই ১১ মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিতেও বেশ ভালো প্রবৃদ্ধিও আছে। সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪৪০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ১১ মাসে (জুলাই-মে) রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১ হাজার ৩০১ কোটি ডলারের।

এর বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ১২০ কোটি ডলারের। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এই ১১ মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কম হয়েছে ১৩.৯৫ শতাংশ। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হলেও এই ১১ মাসে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ০.৪২ শতাংশ। এ সময় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ১ হাজার ১১৫ কোটি ডলার। এক ডলার ১০৮ টাকার হিসাবে আয় এসেছে ১২ হাজার ৯৮ কোটি ৫৯ লাখ ২০ হাজার টাকার।

https://mzamin.com/news.php?news=62285