২৭ জুন ২০২৩, মঙ্গলবার, ৬:৪৭

সরকারের উন্নয়নের দাবি ও একজন মীর কাশেম আলীর কাহিনী

-ড. মো. নূরুল আমিন

কী লিখবো ভেবে পাচ্ছি না, অবসাদ আর উদ্যমহীনতায় মন ভারাক্রান্ত চিন্তা শক্তি আড়ষ্ট। প্রিয় মাতৃভূমি কোন দিকে যাচ্ছে তা অনুমান করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। প্রথম বলেছেন যে, বিএনপি জামায়াত যদি ক্ষমতায় আসে তা হলে দেশ এবং উন্নয়ন দু’টিই ধ্বংস হয়ে যাবে। এরপর গত রোববার সংসদে বাজেটের উপর আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, আমাদের ছাড়া একটা লোক দেখান, যে দেশটাকে এগিয়ে নিতে পারবে। উন্নয়নের জন্য আমাদেরই দরকার। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর সুরে সুর মিলিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন জনগণকে উদ্দেশ করে বলেছেন যে, আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কাউকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনলে দেশে অমঙ্গল ডেকে আনা হবে। দেশ ধ্বংস হলে জনগণও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। পাঠকদের হয়ত মনে আছে যে, কয়েক মাস আগে এই আবদুল মোমেন সাহেবই বলেছিলেন যে, ভারত গিয়ে তিনি ভারত সরকারকে পুনরায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার জন্য অনুরোধ করে এসেছেন।

প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের অনেক মন্ত্রী ও সিনিয়র নেতাদের অসংযত কথাবার্তা জনগণের মধ্যে নানা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে বলে মনে হয়। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বলছেন যে, দেশ গঠন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ও তার দলের যদি এতই আকাশচুম্বি অবদান তা হলে জনগণের ওপর তাদের তো আস্থা থাকার কথা এবং সে ক্ষেত্রে নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করে তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ও নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের তো কোনও ভয় থাকারই কথা না। এতে তিনি এবং তারা রাজি হচ্ছেন না কেন? অথবা তারা আরেকটি কাজও করতে পারেন তা হচ্ছে তাদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জনগণ আওয়ামী লীগকে অনন্তকালের জন্য ক্ষমতায় থাকার ম্যান্ডেট দেন কিনা তা যাচাই এর জন্য একটি গণভোট অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন।

গত প্রায় ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ শাসনামলের অনেকগুলো র্কীতি আছে। তার মধ্যে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারতকে প্রদত্ত সুযোগ সুবিধাগুলো অনন্য। কোনো রকম বিনিময় মূল্য ছাড়া তাদেরকে ট্রানজিট করিডোর প্রদান, বিনা শর্তে ফেনী নদীর পানি উত্তোলন, তিস্তা ও গঙ্গার পানির প্রবাহ থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার অনুমোদন, নদী ও সমুুদ্র বন্দর ব্যবহারে ভারতকে অবাধ স্বাধীনতা প্রদান, তাদের কাছ থেকে চড়া সুদে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তাদের জন্য রাস্তাঘাট ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করে দেয়ার মতো অনেক কিছুই এই সরকার করেছেন। যা প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, ‘ভারতকে আমি যা দিয়েছি জীবনেও তারা তা ভুলতে পারবে না।’ আওয়ামী লীগের উন্নয়নের আরো অনেক গল্প আছে। তাদের উন্নয়নের ঠেলায় বাংলাদেশের মানুষকে ১২/১৪ টাকা কেজি দরের চাল এখন ৭০-৭৫ টাকা কেজি দরে খেতে হচ্ছে। ৩০ টাকা দরের দেশী মসুরির ডাল এখন ১০০ টাকার উপরে। ৩৪ টাকা কেজি দরের চিনি এখন ১৫০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা, গরুর গোশত আড়াইশ টাকা থেকে ৭৫০ টাকা এবং খাসির গোশত ৪০০ টাকা থেকে ১১০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও জীবন রক্ষাকারী এমন কোনো ওষুধ নেই যার দাম ৫০০ শতাংশ থেকে ১০০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়েনি। এই দেড় দশকে ধনী আরো ধনী এবং গরিব আরো গরিব হয়েছে। দেশ এবং দেশের মানুষ দেশী ও বিদেশী ঋণের দায়ে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো লুটপাটের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
তাদের খেলাপীর পরিমাণ সরকারি হিসাব অনুযায়ী মোট দাদনের প্রায় চল্লিশ শতাংশ, তবে ব্যাংকগুলোর প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী এর পরিমাণ ৮০ শতাংশের বেশি এবং এই ঋণ খেলাপীদের ৯০ শতাংশ শাসক দলের নেতাকর্মী। আবার তাদের শাসন আমলের এই দেড় দশকে বিদেশে পুঁজি পাচার হয়েছে প্রায় সাড়ে পনের লক্ষ কোটি টাকা। আবার দেশে আয় বৈষম্য যেভাবে বাড়ছে তা যদি অব্যাহত থাকে তা হলে আগামী এক দশকে এই দেশে মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

এর উপরে রয়েছে গুম, খুন, জেল-জুলুম, নির্যাতন। ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক রাখার জন্য বিরোধীদলের ৩৩ লক্ষ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এই সরকার মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা দিয়ে, রিমান্ডে নির্যাতনের মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় যে নজির স্থাপন করেছে তা ফেরাউনের নির্যাতনকেও হার মানায়। দেশের বিচার ব্যবস্থাসহ সাংবিধানিক যতগুলো প্রতিষ্ঠান ছিল সবগুলোই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশ শাসনের জন্য আর কাউকে খুঁজে না পাবার দাবি অত্যন্ত হাস্যকর বলে মনে হয়। মানুষের ওপর তাদের নির্যাতন, বিডিআর হত্যাকান্ড থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত, তা মনুষ্যত্বের কোনও মানদ-ে মেনে নেয়া যায় না।
কেন জানি না কয়েকদিন ধরে আমার শহীদ মীর কাশেম আলীর কথা মনে পড়ছে। তিনি প্রতিষ্ঠান গড়ার কারিগর ছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত তিনি হত্যার শিকার হয়েছেন।

Anthony Storr একজন নামকরা চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উইনচেস্টার কলেজ ও ক্রাইস্ট কলেজে তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা শেষ করে মানসিক চিকিৎসায় (Psychiatry) বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে দীর্ঘকাল Runwell Mental Hospital এবং মডসলি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। তার লিখিত Human Aggression বইটি পাঠক মহলে অত্যন্ত সমাদৃত। মনোবিজ্ঞানের এই খ্যাতনামা চিকিৎসকের মতে, দুনিয়াতে এ যাবৎ বিচরণকারী নৃশংস আচরণ ও নিষ্ঠুর-নির্মম প্রাণীদের মধ্যে আমরাই হচ্ছি সর্ব নিকৃষ্ট। তার ভাষায়, “The Sombre fact is that we are the cruellest and most ruthless species that has even walked the earth. মানুষ বিপদে পড়লে, অত্যাচারিত হলে, কাউকে গুম বা খুন করলে অথবা বিনা দোষে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হলে এক শ্রেণীর লোকের মধ্যে যে উল্লাস পরিলক্ষিত হয়, পশুর মধ্যেও তা দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে ড. এন্থনি স্টর মানুষের তুলনায় পশুকে অপেক্ষাকৃত শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। তবে সকল মানুষ নয়, কিছু মানুষ যাদের তিনি Psychopath হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং যারা Psychosis বা মানসিক বিকৃতিতে ভোগেন। এরা মানুষকে কষ্ট দিয়ে, তাদের দুঃখ-দুর্দশা উপভোগ করেন। আবার এরা যদি ক্ষমতার মসনদে থাকেন তাহলে গোটা জাতিই তাদের নির্মমতার শিকার হয়।

একটি পশু আরেকটি পশুর উপর নিষ্ঠুরতা চালিয়ে তার দুঃখ দেখে আনন্দ উপভোগ করে না-এই কথাটি বলতে গিয়ে তিনি বিড়ালের ইঁদুর শিকারের প্রসঙ্গটি তুলে এনেছেন। তার পুস্তকের দশম অধ্যায়ে Paranoid Hostility শীর্ষক নিবন্ধে তিনি বলেছেন- “In our brief review of agression in other species we concluded that even animals which prey upon one another do not rejoice in cruelty for its own sake. The cat playing with the mouse before it suddenly kills it, is behaving as it would with any small moving object which gives an opportunity of exercising its skill in catching and pouncing. It is inconceivable that a cat could so identify itself with a mouse as to enjoy. The latters fear. Yet men, with hatred in their hearts take pleasure in prolonging their agonies of helpless victims and show extreme ingenuity in devising tortures which cause the maximum pain and the minimum risk of a quick ending.”

এখানে তিনি বলতে চেয়েছেন একটি পশু অন্য পশুকে শিকার করে এবং শিকার করতে গিয়ে তার প্রতি কঠোর হয়, তাকে যন্ত্রণা দেয় এবং ভীত সন্ত্রস্ত্র করে। কিন্তু পরাজিত পশুর ভীতি ও যন্ত্রণা কিংবা তার মৃত্যুতে সে উল্লসিত হয় না। কিন্তু মানুষ মানুষের উপর নির্যাতন করে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে এবং অসহায় ব্যক্তির উপর নৃশংসতা প্রলম্বিত করে আনন্দ পায়। যেমন আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধীদের উপর আঘাত করে, তাদের পরিবার সদস্য ছেলেমেয়েদের গুম ও হত্যা করে আনন্দ পাই।
শুরুতেই বলেছি মানসিক অস্থিরতা ও অবসাদের কারণে লেখার সাবলীলতা হারিয়ে ফেলেছি এবং যা লিখছি তা অনেকের কাছেই অসংলগ্ন প্রলাপের মতো মনে হবে। সমাজে যখন মানবিক মূল্যবোধের দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে তখন কোন কোন ক্ষেত্রে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম নেতা ও ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা, বিশিষ্ট শিল্প উদ্যোক্তা ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জনাব মীর কাসেম আলীকে কাশিমপুর কারাগারে ২০১৬ সালে আদালতের রায় অনুযায়ী ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। জনাব মীর কাসেম আলী অনন্য প্রতিভার অধিকারী চির সবুজ, জনদরদী, সর্বাবস্থায় একজন হাস্যোজ্জ্বল ব্যক্তি ছিলেন। প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের অধিকারী তার মতো দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির সাক্ষাৎ আমি পেয়েছি কিনা আমার মনে পড়ে না। স্বাধীনতা-পূর্বকালে সাংবাদিকতার পাশাপাশি ঢাকার তৎকালীন কায়েদে আজম কলেজে (বর্তমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) আমি অধ্যাপনা করতাম। ঐ সময়ে অধ্যাপক নূরুদ্দীন নামে কুমিল্লা জেলার কোনও একটি কলেজের একজন অধ্যাপকের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দফতরে আমার পরিচয় হয় এবং কালক্রমে এই পরিচয় গভীরতর হয়। স্বাধীনতা-উত্তর কালে সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়ার পর ১৯৭২ সালের শেষের দিকে কুমিল্লা একাডেমিতে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং-এ অংশগ্রহণকালে অধ্যাপক নূরুদ্দীনের সাথে কুমিল্লা শহরে আমার যোগাযোগ হয় এবং তিনি একদিন তার শ্বশুর বাড়ি আমাকে নিয়ে যান। তার শ্বশুর ছিলেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের একজন কর্মকর্তা। তার বাসাতেই জনাব মীর কাসেম আলীর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় এবং জানতে পারি যে তিনি জনাব নূরুদ্দীনের শ্যালক। তিনি তখন সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অথবা ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তার সাথে কথাবার্তা বলে তার মেধা, আদব-কায়দা ও বুদ্ধিমত্তার যে পরিচয় পেয়েছি তাতে আমি অভিভূত হয়ে পড়ি। এরপর দীর্ঘকাল জনাব মীর কাসেমের সাথে আমার দেখা হয়নি। চাকরি উপলক্ষে নোয়াখালী ও সিলেট ঘুরে ১৯৮১ সালের শেষের দিকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী সেচ প্রকল্পে আমি ডেপুটেশনে নিয়োগ পাই এবং গহিরা শান্তির দ্বীপে ছিল আমার আবাসিক দফতর; নিচে অফিস, উপরে বাসভবন। ঐ সময়ে একদিন হঠাৎ করে মীর কাসেম আলী কয়েকজন সহকর্মীসহ আমার অফিসে উপস্থিত হন। আমার যতদূর মনে পড়ে তিনি তখন রাবেতার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং ঐ প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় রাঙ্গামাটির প্রত্যন্ত অঞ্চল ও কক্সবাজার এলাকায় হাসপাতাল ও অন্যান্য দাতব্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত ছিলেন। জনপ্রশাসন ও জেলা-উপজেলার জাতি গঠনমূলক বিভাগ ও এজেন্সিগুলোর ব্যাপারে তিনি খুবই উৎসুক ছিলেন এবং কিভাবে সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে জনকল্যাণ ত্বরান্বিত করা যায় এ বিষয়েই তিনি আমার সাথে বেশিরভাগ আলাপ-আলোচনা করতেন।

তার সাথে ১৯৮৩ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ যাবার আগ পর্যন্ত আমি দু-তিনবার রাঙ্গামাটিও গিয়েছিলাম এবং সার্কিট হাউজে অবস্থানকালে জনসেবার ব্যাপারে তার দর্শন, কর্মপরিকল্পনা ও পদ্ধতি প্রভৃতি সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছি। এতে তার শিশুসুলভ মন, মানুষের প্রতি তার দরদ, দায়ী ইলাল্লাহ হিসেবে দায়িত্ববোধের পরিচয় পেয়েছি। যুব সমাজের জন্য তাকে আমার একজন রোল মডেল বলেই মনে হয়েছে। ১৯৮৬ সালে বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর আমার ঢাকাতে পোস্টিং হয় এবং এখানে আসার পর তার সাথে বহুবার আমার Interaction হয়েছে। Islamic Economics Research Bureau-তে অন্যদের সাথে তার গতিশীল নেতৃত্ব ও অসামান্য পরিশ্রম বাংলাদেশে সুদবিহীন একটি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও ফলপ্রসূ পরিচালনার ক্ষেত্রে তার অনন্য ভূমিকা ছিল। তিনি প্রচুর লেখাপড়া করতেন এবং যখন আলোচনা বক্তব্যে বিভিন্ন অথরিটিকে কোট করতেন আমি বিস্মিত হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকতাম। বাংলাদেশের বঞ্চিত কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য তার উদ্বেগ ছিল লক্ষণীয়। বাংলাদেশ সরকারের সাবেক শিক্ষা সচিব জনাব ইরশাদুল হক যখন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন তখন জনাব কাসেমের উদ্যোগে তার নেতৃত্বে তিনি একটি ফোরাম গঠন করেছিলেন। ঐ ফোরামের আমিও সদস্য ছিলাম। তার উদ্যোগ, উদ্যম, সাহসী ভূমিকা এবং দরদী মন অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিল। ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন, ইবনে সিনা হাসপাতাল, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস, ইবনে সিনা ট্রাস্ট, ইসলামী ব্যাংক টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, রাবেতা ওয়ার্কশপ প্রভৃতি তার অনন্য কীর্তি। এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি যে পরিশ্রম করেছেন তা কল্পনা করা যায় না। এগুলো তিনি নিজের জন্য গড়ে তোলেননি, তুলেছেন জনগণের খেদমতের জন্য, দেশ-বিদেশে বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য। পাঠকদের নিশ্চয়ই জানা আছে যে, সারা দুনিয়ায় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিকানার কিছু ধরন প্রকৃতি আছে। যেমন Individual Ownership (ব্যক্তি মালিকানা), Partnership (অংশীদারিত্ব ভিত্তিক মালিকানা) এবং Joint Stock Company (যৌথ মূলধনী কোম্পানি)। আবার যৌথ মূলধনী কোম্পানিও দু’ধরনের হয়। একটি প্রাইভেট লিমিটেড আরেকটি পাবলিক লিমিটেড। জনাব মীর কাসেমের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক ব্যাংকিং কোম্পানির অধীনে রেজিস্ট্রিকৃত এবং দক্ষ ও সঙ্গতিসম্পন্ন একটি ব্যাংক যা প্রতিবছর জাতীয় কোষাগারে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব প্রদান করে; এই ব্যাংকটির শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃস্টান সকলেই আছেন এবং এখনো পর্যন্ত ব্যাংকটি দুর্নীতিমুক্ত; সরকারি ও কিছু কিছু বেসরকারি ব্যাংক যেখানে ডাকাতের আস্তানায় পরিণত হয়েছে এই ব্যাংকটি সেখানে সততার রোল মডেল হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। দিগন্ত টেলিভিশন, নয়া দিগন্ত পত্রিকা, ইবনে সিনা হাসপাতাল, ফার্মাসিউটিক্যাল, ট্রাস্ট, ব্যাংক ফাউন্ডেশনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অডিট হয়, সরকারি পরিদর্শন হয়। দুর্মুখরা বলে বেড়ান এগুলো তার ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান এবং তিনি লাখ লাখ কোটি টাকার মালিক। আমি প্রতিষ্ঠানগুলোর রিপোর্ট রিটার্ন, আয় ও ব্যয় বিবরণী এবং অডিট প্রতিবেদন অধ্যয়ন করে পূর্ণ দায়িত্বশীলতার সাথে বলতে পারি যে, এসব প্রতিষ্ঠান থেকে মীর কাসেম আলী অথবা তার পরিবার অথবা জামায়াতের অর্থ নেয়ার কোনো দৃষ্টান্ত নেই। বরং বিভিন্ন চাপ দিয়ে সরকারই বিভিন্ন তহবিলে তাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। তার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রত্যেকটিই লাভজনক, কারণ এখানে সৎ ও যোগ্য লোকের সংখ্যাই বেশি। এ জন্য জনাব কাসেমকে পুরস্কার দেয়া সরকারের জাতীয় কর্তব্য ছিল। কিন্তু তারা তা করেননি। মীর কাসেমের পারিবারিক অবস্থা জানলে অনেকেই অবাক হবেন। আগামী কুরবানিতে গরু কেনার জন্য তার পরিবারের হাতে কোনো অর্থ নেই। তিনি ও তার পরিবার যে বাড়িটিতে থাকতেন বা থাকেন, সেই বাড়িটি অনেক পুরাতন যার মধ্যে আধুনিকতার কোনো ছাপ নেই। দুপুরে বহুদিন আমি তাকে চিড়া আর কলা দিয়ে লাঞ্চ সারতে দেখেছি। আমি আশ্চর্য হই অনেকগুলো পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল তাকে ধনকুবের বলে আখ্যায়িত করে। সেনা সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে রাজপ্রাসাদের ছবিসহ অনেক ধনকুবের তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল, অনেকের বিরুদ্ধে ট্যাক্স ফাঁকির অভিযোগ উঠেছিল। কই মীর কাসেমের কথা তো তখন উঠেনি? এখন গুজব তোলা হচ্ছে কেন? এই মিথ্যা গুজবে সরকারও অংশ নিচ্ছেন কেন? এই সরকারের প্রতি আমার জিজ্ঞাসা, আপনারা উন্নয়নের বড় বড় দাবি করছেন। মীর কাশিম আলীর মতো দু-একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার নজির কি স্থাপন করতে পেরেছেন।

https://dailysangram.info/post/528528