২৬ জুন ২০২৩, সোমবার, ১২:২৪

আলোচনায় সেন্টমার্টিন দ্বীপ

জীববৈচিত্র্যে ভরপুর কোরাল দ্বীপে আদৌ সামরিক স্থাপনা নির্মাণ সম্ভব কি?

জীববৈচিত্র্যে ভরপুর বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপ। এক দিকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইসিএ), অন্য দিকে ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত এই ছোট প্রবাল দ্বীপটি সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল। দেশের প্রধান রাজনৈতিক নির্বাহী, প্রধান বিরোধী দলের মুখ্য নেতা ও ঢাকাস্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই কথা চালাচালি হয়েছিল। সে বিষয় নিয়ে সক্রিয় রাজনীতিক, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, বোধ্যা সমাজ পুরোপুরি অবহিত।

এ দিকে বাংলাদেশ সরকার সেন্টমার্টিন দ্বীপকে প্রায় দুই যুগ আগেই প্রতিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করেছে, অন্য দিকে উন্নত বিশ্বও কোরাল দ্বীপগুলোতে বিদ্যমান স্থাপনাগুলো সরিয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। এমনি প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরস্পর বিরোধী এসব বক্তব্যের পর এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি দ্বীপটি চায়, নিশ্চয়ই সামরিক স্থাপনার জন্য চায়, কিন্তু কোরাল দ্বীপে আদৌ সামরিক স্থাপনা নির্মাণ সম্ভব কি?

প্রায় আট হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত সেন্টমার্টিন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মৌসুমি জলবায়ু বেষ্টিত বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যপূর্ণ একমাত্র প্রতিবেশগত দ্বীপ যেখানে কোরাল পাওয়া যায়। মাত্র আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের (ভাটার সময় ১০-১৫ বর্গকিলোমিটার) সেন্টমার্টিন দ্বীপের অবস্থান কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে ও মিয়ানমারের উপকূল থেকে আট কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায়। অনেক নারিকেল পাওয়া যায় বলে স্থানীয়ভাবে একে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান হওয়ায় ভূ-রাজনৈতিকভাবেও দ্বীপটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত উত্তেজনার সময়ে বিশেষ করে ২০০৭ সালে দ্বীপটির কাছাকাছি নৌবাহিনীর বিভিন্ন যুদ্ধজাহাজ অবস্থান নিয়েছিল।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ওশানোগ্রাফি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন মুন্না নয়া দিগন্তকে বলেন, কোরাল ইকোসিস্টেম হলো একটা বিশেষায়িত ইকোসিস্টেম যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জীববৈচিত্র্যের সমাহার। তিনি বলেন, সমুদ্রের তলদেশের এক শতাংশেরও কম জায়গা প্রবাল এলাকা হিসেবে দখল করলেও এখানে সমস্ত সামুদ্রিক জীবনের ২৫ শতাংশেরও বেশি বাস করে। বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপ তথা প্রবাল ইকোসিস্টেমও এর ব্যতিক্রম নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।

২০১৯ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ‘প্রতিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ’ শীর্ষক নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী- দেশের একমাত্র প্রবাল সমৃদ্ধ এ দ্বীপে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল আছে। ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ক বা কড়ি-জাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। এ ছাড়া এখানে ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এখানে পাঁচ প্রজাতির বাদুড় ও দুই প্রজাতির ডলফিনেরও বাস। স্থানীয়ভাবে পেজালা নামে পরিচিত সি উইড বা অ্যালগি এক ধরনের সামুদ্রিক শৈবাল, যা সেন্ট মার্টিনে প্রচুর পাওয়া যায়। এগুলো বিভিন্ন প্রজাতির হয়ে থাকে, তবে লাল অ্যালগি বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয়। অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে স্পঞ্জ, শিল কাঁকড়া, সন্যাসী শিল কাঁকড়া, লবস্টার ইত্যাদি। মাছের মধ্যে রয়েছে পরী মাছ, প্রজাপতি মাছ, ভোল কোরাল, রাঙ্গা কই, সুঁই মাছ, লাল মাছ, উড়ুক্কু মাছ ইত্যাদি। সামুদ্রিক কচ্ছপ সবুজ সাগর কাছিম ও জলপাই রঙ্গা সাগর কাছিম প্রজাতির ডিম পাড়ার স্থান হিসেবে জায়গাটি খ্যাত। দ্বীপে কেওড়া বন ছাড়া প্রাকৃতিক বন বলতে যা বোঝায় তা নেই। তবে দ্বীপের দক্ষিণ দিকে অনেক কেওড়ার ঝোপঝাড় আছে। দক্ষিণ দিকে কিছু ম্যানগ্রোভ গাছ আছে। অন্যান্য উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে কেয়া শ্যাওড়া, সাগরলতা, বাইন গাছ ইত্যাদি।

সমুদ্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোসলেম উদ্দিনের মতে সরকারি ওই তথ্যই বলে দেয় আমাদের প্রবাল প্রাচীর কী পরিমাণ জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই ইকোসিস্টেম এখন বিপর্যস্ত।

ওই প্রতিবেদন বলছে, বিভিন্ন গবেষণার তথ্য অনুযায়ী সেন্টমার্টিন দ্বীপের পর্যটক ধারণক্ষমতা দৈনিক ১৮৩৫ জন। কিন্তু সেখানে এখন দৈনিক পাঁচ-সাত হাজার পর্যটক ভিড় করছেন। ফলে এসব পর্যটকের চাপে দ্বীপে পরিবেশ দূষণের মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করে। বিপুলসংখ্যক পর্যটককে সেবা দিতে গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত নানা স্থাপনা, দোকানপাট। বেড়েছে বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য। সৈকতে যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে প্লাস্টিকবর্জ্য।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের (১৯৯৫) আওতায় ১৯৯৯ সালে সরকার সেন্টমার্টিন দ্বীপকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। ওই ঘোষণার মাধ্যমে এ অঞ্চলে প্রকৃতির কোনো প্রকার পরিবর্তন বা পরিবর্ধন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ছাড়া ২০২২ সালে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী সেন্টমার্টিন দ্বীপ সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১,৭৪৩ বর্গ কিমি. এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়।

সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সেন্টমার্টিন ইস্যুতে বক্তব্য আসার পর জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যেখানে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারই ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে ইসিএ ঘোষণা করে সেখানকার প্রকৃতির কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধনকে আইনত দণ্ডনীয় ঘোষণা করেছে, সে ক্ষেত্রে বিদেশীরা কিভাবে সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করবে? তা ছাড়া বৈশ্বিকভাবে কোরাল দ্বীপে সামরিক স্থাপনাতো দূরে থাক বড় ধরনের কোনো স্থাপনাই নাই, বরং যেসব স্থাপনা আছে সেসব স্থাপনাও সরিয়ে নিয়ে রেস্টোরেশন প্রকল্প গ্রহণ করছে উন্নত বিশ্ব। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বৈশ্বিক অর্থায়নের উল্লেখযোগ্য অংশ যেখানে বিশ্বমোড়লরা জোগান দেয়, সেখানে বিপুল জীববৈচিত্র্যের আধার প্রবাল দ্বীপের ইকোসিস্টেম ধ্বংস করে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নেয়ার প্রসঙ্গটিও সামনে চলে আসছে কারো কারো মতে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/758274