২৪ জুন ২০২৩, শনিবার, ৮:৫৪

শ্রমিকের ‘মরণফাঁদ’ সেপটিক ট্যাঙ্ক

নির্মাণাধীন ভবনের সেপটিক ট্যাঙ্কের সাটারিং খুলতে নামেন শ্রমিক মো. সামাদ। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে উদ্ধারে নামেন মধু মিয়া। ডাকাডাকি করে দু’জনের কারও সাড়া না পেয়ে ঠিকাদার নিজেই নেমে পড়েন। ভাগ্য ভালো, সেখানে উপস্থিত অন্যরা সময়মতো ঠিকাদারকে ওপরে ওঠাতে পেরেছেন। খবর পেয়ে গত ২৮ মে রাজধানীর উত্তরখানের ওই সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সামাদ ও মধুর লাশ উদ্ধার করেন। মর্মন্তুদ এ ঘটনার রেশ না কাটতেই পরের দিন কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের আটঘরা গ্রামে একটি বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কারে নেমে মারা যান দিনমজুর মো. শাহজালাল (৫৮)। শ্রমিকের ‘মরণফাঁদ’ হয়ে ওঠা সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কারে নেমে বিষাক্ত গ্যাসে প্রায়ই সামাদ-শাহজালালের মতো প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে। এমনকি উন্মুক্ত সেপটিক ট্যাঙ্কে পড়ে প্রাণ গেছে অনেক শিশুর।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা ও গ্যাস ডিটেক্টর ছাড়া কারও সেপটিক ট্যাঙ্কে নামা উচিত নয়। ট্যাঙ্ক পরিষ্কার অবশ্যই পেশাদার লোক দিয়ে করাতে হবে। তাহলে এ ধরনের মৃত্যুঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হবে।

গত ১৫ মার্চ আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানার সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কারে নেমে প্রাণ হারান তিনজন। ১৭ এপ্রিল মৌলভীবাজারের পশ্চিমজুড়ীতে নির্মাণাধীন ভবনের সেপটিক ট্যাঙ্কের সাটারিং খুলতে নেমে বিষাক্ত গ্যাসে মারা যান দুই শ্রমিক। ১৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে নির্মাণাধীন ভবনের সেপটিক ট্যাঙ্কে নেমে মৃত্যু হয় দুই শ্রমিকের। গত ২১ এপ্রিল খুলনার খালিশপুরে চিত্রালী সুপার মার্কেটের নির্মাণাধীন সেপটিক ট্যাঙ্কে পড়ে মারা যায় সাত বছরের শিশু আব্দুল্লাহ। পুরান ঢাকার চকবাজারে নিখোঁজের একদিন পর ১১ ফেব্রুয়ারি বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে উদ্ধার করা হয় আরিয়ানের লাশ (৬)। পরে জানা যায়, খেলতে গিয়ে অসাবধানতায় সে নিচতলায় ঢাকনা খোলা সেপটিক ট্যাঙ্কে পড়ে যায়।

সেপটিক ট্যাঙ্কে প্রায়ই প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কাছে সঠিক তথ্য নেই। তবে সংস্থাটি জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত দেশে এ ধরনের ১৮টি দুর্ঘটনায় আটজনের মৃত্যু হয়েছে। অসুস্থ হয়েছেন অন্তত পাঁচজন। তবে প্রাণহানি যে আরও বেশি, তা উপরে বর্ণিত ঘটনাগুলো থেকেই স্পষ্ট।

বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া বলেন, ‘বদ্ধ ট্যাঙ্কে মিথেন, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড, সালফার ডাই অক্সাইডসহ বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস তৈরি হতে পারে। অক্সিজেনের স্বল্পতাও থাকে। এজন্য ভেতরে ঢুকলে প্রথমেই অক্সিজেনের অভাবে দ্রুত জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারেন। বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।’

বিস্ফোরক অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান পরিদর্শক শামসুল আলম বলেন, ‘সিমেন্ট দিয়ে তৈরির কারণে আবদ্ধ নতুন সেপটিক ট্যাঙ্কে কার্বন-ডাই অক্সাইড জমা হতে থাকে। এ ছাড়া পানির ট্যাঙ্কেও বিষাক্ত গ্যাস জমা হয়। কারণ ওয়াসার পানিতে জীবাণুনাশক হিসেবে মেশানো হয় ক্লোরিন গ্যাস। পানির ট্যাঙ্কের নিচে সেই গ্যাস জমতে থাকে। দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করলে মিথেন, অ্যামোনিয়া গ্যাস জমা হয়ে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। এজন্য সেপটিক ট্যাঙ্কে নামার সময় অক্সিজেন মাস্ক ব্যবহার করা নিরাপদ। অক্সিজেন মাস্ক না থাকলে প্রচুর পাতাসহ গাছের ডাল কেটে দড়িতে বেঁধে নামালেও ভেতরের বিষাক্ত গ্যাস বের হওয়ার সুযোগ পায় এবং অক্সিজেন তৈরি হয়।’

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার বলেন, ‘সেপটিক ট্যাঙ্কের সঙ্গে পাইপ দিয়ে গ্যাস বাইরে বের করার ব্যবস্থা রাখা দরকার। সতর্কতা হিসেবে বদ্ধ সেপটিক ট্যাঙ্কে নামার আগে কুপি, মোমবাতি বা হারিকেন জ্বালিয়ে রশি দিয়ে বেঁধে ভেতরে দিতে হবে। এগুলো জ্বলতে থাকলে বুঝতে হবে বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতি নেই, তখন নামলে কোনো অসুবিধা হবে না। বিষাক্ত গ্যাস থাকলে বাতি ধপ করে নিভে যাবে। বিষাক্ত গ্যাস বের করতে ঢাকনা খুলে রাখতে হবে ও প্রচুর পরিমাণে বাতাস প্রবেশ করাতে হবে।’

https://samakal.com/bangladesh/article/2306179981