২৩ জুন ২০২৩, শুক্রবার, ৯:১৯

দখলের মুখে রাজধানীর ২৬ শতাংশ জলাশয়

ঢাকা মহানগরীর অবশিষ্ট ৩২৭ পুকুর ও জলাশয়ের মধ্যে ৮৬টি (যা প্রায় ২৬%) এখন সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী ব্যক্তি কর্তৃক দখলের পথে। জলাধারগুলোর মধ্যে ছয়টি দখল হচ্ছে সরকারি উদ্যোগে, ৭৯টি দখল হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগে এবং বাকি একটি দখল হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে। ঢাকায় পুকুর ও জলাধারের প্রয়োজনীয়তা শীর্ষক এক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এসব তথ্য তুলে ধরেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার-আরডিআরসি এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোট (বাংলাদেশ ন্যাচার কনজারভেশন অ্যালায়েন্স-বিএনসিএ) ও গে-ারিয়ায় ডিআইটি পুকুর রক্ষা আন্দোলনের যৌথ উদ্যোগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘ঢাকায় পুকুর ও জলাধারের প্রয়োজনীয়তা এবং সংরক্ষণে করণীয়’ শীর্ষক এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদারের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন, বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ, ঢাকা ৪ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক বজলুর রশিদ, বিএনসিএ এর যুগ্ম আহ্ববায়ক ও নোঙর ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী সুমন শামস, বিএনসিএ-র সদস্য সচিব ও সেভ আওয়ার সি’র সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক (গাজী আনোয়ার) ও নিরাপদ ডেভেলাপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানা। আরও বক্তব্য রাখেন পরিবেশ সংক্রান্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ইনিশিয়েটি ফর পিস (আইএফপি)’ এর চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শফিকুর রহমান, যাত্রী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক কেফায়েত উল্লাহ চৌধুরী শাকিল, গে-ারিয়া ডিআইটি প্লট পুকুর রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক ইব্রাহীম আহমদ রিপন।

বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, আমাদের হাউজিংগুলো আকিকা করে নাম বদলে ফেলছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সেখানে অসহায়। রাজউক নিজেই জলাশয় ভরাট করে হাউজিং করছে। অপরদিকে মেয়রদের উন্নয়নের ধারণা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও কাজ করছে।

রিজওয়ানা হাসান বলেন, ছোটবেলায় পড়েছি পানিই জীবন। এখন ঢাকায় মনে হচ্ছে বিল্ডিংই জীবন। গত ৫০ বছরে এই পরিবর্তন হয়েছে। আমরা পুকুর ও জলাধারের পানি কমে যাওয়ার কথা বলছি। অথচ আমাদের ভূগর্ভস্থ পানিও কিন্তু কমে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি কতটুকু কমে যাচ্ছে সেটার চিত্র সরকার আমাদের কখনো বলবে না। ভূগর্ভস্থ পানি ৩-৫ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। ফলে আমরা প্রায়ই দেখি এখন ছোট ছোট ভূমিকম্প হচ্ছে। মোহাম্মদ এজাজ আরও বলেন, ‘আমরা গবেষণা করে দেখেছি, ঢাকায় বর্তমানে মোট ৬৩টি খাল, ১৩টি লেক ও একটি আদি চ্যানেলের অস্তিত্ব রয়েছে। সরকারিভাবে জলাধারের এখনও কোনো তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। নিজেদের প্রয়োজনে এসব পুকুর ও জলাধার রক্ষা করতে হবে। আইন অনুযায়ী যে কোনো ধরনের জলাধার ভরাট নিষিদ্ধ। ব্যক্তি মালিকালাধীন হলেও জলাধার ভরাট করা যে যাবে না, এ ব্যাপারে রাজউকে সার্কুলার ইস্যু করতে পারে। রাজউক আরও সক্ষম ও সক্রিয় হলে ঢাকার জলাধার রক্ষা পাবে। প্রতিটি পুকুরের সামনে এখনই সাইনবোর্ড টানিয়ে দিতে হবে।’

তিনি বলেন, আগে ঢাকায় প্রতিটি বাসার সামনে বাগান থাকত, এখন সেটা দেখা যায় না। ঢাকা এখন বাগানবিহীন নগরীতে পরিণত হয়েছে। এত কিছু হলে আমাদের জলাধার আইন ও রাজউক দিয়ে কী হবে। ঢাকার উন্নয়ন পরিকল্পনা জনগণ করবে, সেটার বাস্তবায়ন করবে সিটি কর্পোরেশন ও রাজউক।

পুকুর, বিল ও লেকের তথ্যচিত্র তুলে ধরে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ঢাকায় পুকুর, বিল ও লেক আছে ৩২৭টি। বর্তমানে পুকুর আর বিল ২৪১টি ও লেক রয়েছে ৮৬টি। বর্তমানে পুকুর ভরাট করে দালানকোঠা নির্মাণ করা হচ্ছে। পুকুর তুলনামূলক ছোট হওয়ায় সহজেই দ্রুত দখল ও ভরাটের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে ৯০ ভাগ ছোট পুকুর দখল ও ভরাট করা হচ্ছে। ঢাকাকে বসবাসের উপযোগী করতে এসব জলাধার দখলমুক্ত করতে হবে। গবেষণা প্রবন্ধে ঢাকার পুকুর, জলাধার ও খাল বিলের নানা বিষয়ের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ৩০৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে পুকুর জলাধার দখল হচ্ছে।

আরডিআরসির গবেষণায় ঢাকার ভূমি আচ্ছাদনের এক প্রতিবেদন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকায় ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ বসতবাড়ি, বাজার ও শিল্প-কারখানা রয়েছে। কৃষি জমি রয়েছে ১৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ, গাছপালা ১৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ ও জলাভূমি ১৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। পুকুর ও জলাশয় দখলের চিত্র তুলে তিনি আরও বলেন, ঢাকার ৩২৭টি পুকুর ও জলাশয়ের বর্তমানে দখল করা হয়েছে ৮৬টি। এর মধ্যে সরকারিভাবে দখলে রয়েছে ৬টি আর বেসরকারিভাবে দখলে ৭৯টি। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে জলাশয় ভরাট, সবুজ এলাকা নিধন, জলাশয় সংরক্ষণ আইন না জানা, আইনি জটিলতা ও স্থানীয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি ও রাজউকের সমন্বয়ের অভাবসহ নানা কারণে পুকুর দখল করে ভরাট করা হচ্ছে।

এসময় ঢাকা ৪ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, ঢাকার যেসব পুকুর রয়েছে সেগুলো সংরক্ষণ করা উচিত। আমি কথা দিলাম, আগামী সংসদে পরিবেশের ওপর কথা বলব। ঢাকাসহ দেশের পুকুর জলাধার সংরক্ষণের বিষয়টি সংসদে জানাব। তিনি বলেন, পরিবেশ রক্ষায় যত সাহায্য-সহযোগিতা করা দরকার আমি করব। আমার এলাকার পুকুর নিয়ে আগেই কাজ করেছি। আমরা সবাই একান্তভাবে কাজ করলে পুকুর দখল রোধ করা সম্ভব।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য বলা হচ্ছে। রাজধানীতে বসবাসের জন্য মানুষ যেখানে কমার কথা সেখানে জলাধার কমেছে আর মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। এখানে যদি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো নগরীর ভালো মেয়রকেও আনা হয় তিনিও ঢাকা নগরীকে এখন বাসযোগ্য করা সম্ভব হবে না। আমাদের এখন দরকার জলাধার দখলমুক্ত করা।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক বজলুর রশিদ বলেন, অগ্নিনির্বাপণের জন্য পুকুর অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যেসব এলাকায় অগ্নিকা- ঘটে সেসব এলাকায় যদি পুকুর থাকে তাহলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হয়। তবে পুরান ঢাকায় এমনও বাসা রয়েছে যেখানে গোসল করার পানি থাকে না।

https://dailysangram.info/post/528213