২২ জুন ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১১:১৮

ভোটার কম, ইভিএমে ভোগান্তি রাজশাহী ও সিলেট সিটি নির্বাচন

ভোটের প্রতি আগ্রহহীনতা অন্য দিকে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অংশ না নেয়াতে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। সমালোচিত ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) জটিলতায় ও বিকল হয়ে যাওয়ায় ভোট গ্রহণে ধীরগতি ও ভোটারের ভোগান্তি ছিল রাজশাহী ও সিলেট সিটি নির্বাচনের ভোটগ্রহণে। ফলে ভোটাররা ছিল ক্ষুব্ধ। ভোটগ্রহণে ধীরগতির কারণে নির্ধারিত সময়ের পরেও কিছু কেন্দ্রে ভোট নিতে হয়েছে। আঙুলের ছাপ মেলাতেও সমস্যায় পড়তে হয়। ভোট দিতে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে ইভিএম দিয়ে করা নির্বাচনের ভোট গ্রহণে। কাজী হাবিবুল আউয়ালের সময়ে এর আগে বিভিন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও ইভিএম জটিলতার শিকার হয়েছেন ভোটাররা। ভোটের ফলাফল পেতেও অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার-সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, শতভাগ ভোট কখনোই নিশ্চিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও শতভাগ ভোট পড়ে না। ৫০ শতাংশ ভোট গুড এনাফ। ৬০-৭০ শতাংশ হলে এক্সিলেন্ট। আমরা চেষ্টা করে যাব। এবার ইভিএম নয় বৃষ্টির কারণে বিলম্ব হয়েছে। ড. বদিউল আলম মজুমদার নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, শুধু রাজনৈতিক দল নয়, ভোটারদেরও নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ নেই। ইসি ও নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর তাদের আস্থা নেই। যে কারণে ভোটাররাও আসেনি।

সরেজমিনের তথ্য বলছে, এবারেই প্রথম সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট দিয়েছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটাররা। একেকজন ভোটারের ইভিএমে ভোট দিতে সময় বেশি লাগে। আঙুলের ছাপ মেলাতেও সমস্যায় পড়তে হয়। ভোট দিতে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছিল। অনেক কেন্দ্রে উপস্থিতির তুলনায় ভোট পড়ার হার ছিল কম। ইভিএম নিয়ে অপেক্ষমাণ ভোটাররাও ছিলেন ক্ষুব্ধ। সিলেটেও ভোট চলাকালে বেশির ভাগ কেন্দ্রে ইভিএম জটিলতায় ভোগান্তিতে পড়তে হয় ভোটারদের। ধীরগতির এ ভোটের কারণে অনেক ভোটারই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। এমনকি একটি কেন্দ্রে ইভিএম বিকল হয়ে পড়ায় ৪০ মিনিট ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল।
এ দিকে দুই সিটি নির্বাচনে রাজশাহীতে একটি ভোটকেন্দ্রে একাধিকবার নারী ভোটারদের নিয়ে গোপনকক্ষে প্রবেশ করায় এক নারীকে গ্রেফতার করে তিন দিনের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ঢাকায় বসে সিসিটিভি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণে ওই নারীকে গোপনকক্ষে ঢুকতে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

ভোট গ্রহণের সাথে সংশ্লিষ্ট সিলেটের ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, প্রথমবারের মতো ইভিএমে ভোট হওয়ায় অভিজ্ঞতার অভাবে অনেকে ভোট দিতে অসুবিধায় পড়েছেন। বেশির ভাগ ভোটার ভোট দিতে কমপক্ষে পাঁচ থেকে সাত মিনিট সময় নেন। এ ছাড়া বেশির ভাগ কক্ষ অন্ধকার থাকায় ভোট নিতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। এতে পর্যাপ্ত ভোটারের উপস্থিতি থাকলেও ভোট গ্রহণে বিলম্ব হয়।

আর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন ভোটে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে বৃষ্টির জন্য কিছুক্ষণ ভোটগ্রহণে ব্যাঘাত ঘটেছিল। এই দুই সিটি ভোট নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। তিনি বলেন, রাজশাহীতে আনুমানিক ৫২ থেকে ৫৫ শতাংশ উপস্থিতি হয়েছে। সিলেটে কম বেশি ৪৬ শতাংশ উপস্থিতি জানতে পেরেছি। কিছুটা হেরফের হতে পারে। টাঙ্গাইলের বাসাইল পৌরসভা নির্বাচনও ভালো হয়েছে। ৭০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি হয়েছে।

সিইসি হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমরা নির্বাচন মনিটরিং করেছি দিনভর। সকাল ৮টা থেকে শেষ পর্যন্ত। আমি বলব নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও আনন্দমুখর পরিবেশ সম্পন্ন হয়েছে। আধা ঘণ্টা প্রবল বৃষ্টির কারণে কিছুটা ব্যাঘাত হয়েছে। তবে ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়নি।

স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচন হয়েছে। আমরা যে কারণে সন্তুষ্ট বোধ করছি, কোনোরকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। যেটা নির্বাচনে প্রত্যাশা থাকে, ভোটার অবাধে এসে ভোট দিতে পারেন কিনা, সেই প্রশ্নে আমরা বলব, তারা এসেছেন। অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার খবর আমরা পাইনি। আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে নজর রাখছিলাম। সেখানে প্রতিবেদকরা অপ্রীতিকর ঘটনার কোনো সংবাদ দেননি। আমরা মনে করি সার্বিকভাবে আজকের নির্বাচন ভালো হয়েছে।

রাজশাহী সিটিতে এক নারী বারবার গোপনকক্ষে প্রবেশ করায় ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, সেটা আমরা তদন্ত করব। সিসি ক্যামেরায় আমরা দেখেছি একজন নারী একাধিকবার ভেতরে যাচ্ছেন। ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। আধা ঘণ্টার মধ্যে জানতে পেয়েছি বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট তাকে তিন দিনের সাজা দিয়েছেন। এটা একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে। তবে সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা দেখল না কেন, আমরা সেটা তদন্ত করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।

সার্বিক মূল্যায়নটা হচ্ছে পাঁচটি নির্বাচন ভালো হয়েছে। এটি জাতীয় নির্বাচনকে উৎসাহিত করবে। ভোটারদের উৎসাহিত করবে। ভোটাররা কেন্দ্রে যেতে আগ্রহবোধ করবে। তারপরও ভবিষ্যতেরটা ভবিষ্যতে দেখব, বলেন সিইসি। তিনি বলেন, আমরা নিশ্চিত করে কিছু বলব না। জিনিসটা ভালোর দিকে যাচ্ছে, যারা রাজনীতিবিদ, প্রার্থী হবে, ভোটাররা, তাদের সবার মধ্যে একটা ইতিবাচক চিন্তাচেতনা সৃষ্টি হতে পারে। ভোট দেয়া ও ভোটগ্রহণকে উৎসাহিত করবে।

স্থানীয় সরকার বিশ্লেষক ড. বদিউল আলম মজুমদারের সাথে গতকাল মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ইভিএমে তো জটিলতা আছে। এটা একটা নির্দিষ্ট যন্ত্র। এটা দিয়ে তো ফলাফল পরিবর্তন করা সম্ভব। এটা গ্রহণীয় পদ্ধতি নয়। তিনি বলেন, প্রতিবাদের মুখে নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এই সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। তিনি বলেন, ইভিএমে ভোট দিতে গিয়ে বায়োমেট্রিক ছাপ না মেলায় অনেকে অতীতে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মানুষ বিরক্ত হয়ে চলে গেছেন। এখানে ইভিএম মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।

সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রসঙ্গে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এখানে নির্বাচন কোথায় পেলেন? এটা তো একটা জাস্ট ভোটাভুটি হয়েছে। এখানে তো কোনো বিকল্প ছিল না। প্রধান বিরোধী দল অংশ নেয়নি। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও শেষ সময়ে সরে গিয়েছে। সে হিসেবে এটাকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলা যায় না। কারণ এই নির্বাচনের ফলাফল অনেকটা পুনর্নির্ধারিত ছিল। তিনি বলেন, সিইসি বলেছেন জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে আস্থা বাড়বে। কিন্তু অন্য তো এই ভোটেই আসেনি। কেন অন্য দল আসেনি? নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা নেই।

ইসির প্রকাশ করা ভোটার উপস্থিতি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বদিউল আলম বলেন, ইভিএমের কল্যাণে যে ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয়েছে সেটাও ঠিক কিনা দেখতে হবে। তিনি বলেন, অবশ্যই ইভিএমে টেম্পারিংয়ের সুযোগ আছে। এটা একটা নির্দিষ্ট যন্ত্র। এটা দিয়ে ফল পরিবর্তন করা সম্ভব। এটা গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি না।

তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ ভিন্ন। সেই নির্বাচনে ক্ষমতা বদল হবে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের যে আইনি ও সাংবিধানিক কাঠামো তা হলো ক্ষমতাসীনদের বিজয় নিশ্চিত করে। অন্যদের সুযোগ নেই। তাই ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে সেই আশা দুরাশা মাত্র।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/757313