২০ জুন ২০২৩, মঙ্গলবার, ১০:৪৬

ধেয়ে আসছে বন্যা

তিস্তা ও সুরমার পানি বিপদসীমার ওপরে

দেশের সব নদনদীর পানি বাড়ছে। তিস্তা ও সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে গ্রাম, বিল, শাকসব্জির ক্ষেতে পানি ঢুকে পড়েছে। তলিয়ে গেছে নিম্নাঞ্চল। বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্যার আশঙ্কা প্রকাশ করায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মাসহ দেশের প্রধান নদনদীতে আগামী ৭২ ঘণ্টা পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। আর দুধকুমার নদীর পাটেশ্বরী পয়েন্টে আজকের মধ্যে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করার শঙ্কা রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া স্বারিত এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ‘ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীগুলোর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।’

এতে বলা হয়, সুরমা, কুশিয়ারা, সারিগোয়াইন, ঝালুখালি, ভোগাই কংশ, সোমেশ্বরী ও যদুকাটাসহ বিভিন্ন নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। পানি বাড়বে তিস্তা ও ধরলাতেও।
পূর্বাভাস অনুযায়ী, উজানে ও দেশের অভ্যন্তরে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সকল প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অন্য দিকে আবহাওয়া সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস অনুযায়ী, বিরাজমান অবস্থায় দেশের উজানে ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে, যার ফলে এ সময়ে এ অঞ্চলের নদনদীগুলোর (সুরমা, কুশিয়ারা, সারিগোয়াইন, ঝালুখালি, ভোগাই কংশ, সোমেশ্বরী, যদুকাটা) পানি সমতল দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে এবং সিলেট ও সুনামগঞ্জের কিছু পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করে সংলগ্ন নি¤œাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।’

এতে বলা হয়, ‘আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার অববাহিকা ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে, যার ফলে এ সময় এ নদীগুলোর পানি সমতল সময়বিশেষে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। দুধকুমার নদী পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।’ দেশের নদনদীর মধ্যে এখনো ১০৯টি নদনদীর মধ্যে ৮৯টির পানি বৃদ্ধি পেয়েছে, কমেছে ১৬টির। এখন পর্যন্ত অপরিবর্তিত রয়েছে চারটি নদীর পানি।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, উজানে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এই অবস্থায় অনেক নদ-নদীর পানি বাড়ছে। সুনামগঞ্জ ও সিলেটের নি¤œাঞ্চলের কিছু এলাকায় স্বল্পমেয়াদি বন্যা হতে পারে।

এ দিকে আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল হয়ে উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় রয়েছে।
বাসস জানায়, টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে সিলেটে নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে ১৮ ঘণ্টার ব্যবধানে পানিপ্রবাহ ফের বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, সিলেটে সুরমা, কুশিয়ারা, সারি, পিয়াইন, ধলাই, জাদুকাটাসহ ছোটবড় নদীর পানি বাড়ছে। সুরমার পানি গত শনিবার বিকেলে সীমান্তবর্তী কানাইঘাটে বিপদসীমা অতিক্রম করে। পরে পানি কিছুটা কমে বিপদসীমার নিচে গেলেও গতকাল সোমবার ৯ ঘণ্টায় ৬২ সেন্টিমিটার বেড়েছে। বর্তমানে এই পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টে পানি বাড়লেও বিপদসীমার নিচে অবস্থান করছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে আজ বিকেল ৩টা পর্যন্ত এই পয়েন্টে পানি বেড়েছে ৩৩ সেন্টিমিটার। বর্তমানে বিপদসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তবে কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়ার প্রবণতা তুলনামূলক কম। এছাড়া সীমান্তনদী পিয়াইন, ধলাই, সারির পানিও বাড়ছে। এতে গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাটসহ সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোর নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আগামী ২১ জুন বুধবার সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে ঘিরে নগরে যখন উৎসব আমেজ তখন বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় প্রার্থীরা কিছুটা আতঙ্কে রয়েছেন। দ্রুত পানি বাড়লে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র পানিতে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কাও রয়েছে।

নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত রোববার রাত থেকে তিস্তা নদীর পানি নীলফামারীর ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে বাড়তে থাকে এবং সোমবার সকাল ৬টার পর থেকে বিপদসীমার পাঁচ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক নূরুল ইসলাম জানান সোমবার সকাল ৬টা থেকে তিস্তার পানি বিপদসীমার পাঁচ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও ১০টার পর থেকে তিস্তার পানি কমতে শুরু করে এবং দুপুর ১২টায় পানি কমে বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ দিকে পানির গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। হঠাৎ করে তিস্তা নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় নদী তীরবর্তী ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার নি¤œাঞ্চলের বাড়িঘরে পানি উঠেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আসফাউদ দৌলা জানান, উজানের ঢলে তিস্তার পানি ভোর থেকে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ব্যারাজের সব ক’টি জলকপাট খুলে দেয়া হয়েছে।
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারসহ ১৬টি নদনদীর পানি। পানি বৃদ্ধি পেলেও এখন পর্যন্ত সব পয়েন্টে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি ঢুকে পড়ছে নদনদী অববাহিকার চরাঞ্চল ও নি¤œাঞ্চলগুলোতে। তবে এখনো ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ না করলেও তলিয়ে গেছে এসব এলাকার পটোল, ঢেঁড়সসহ বিভিন্ন সবজিক্ষেত।

এ দিকে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যার আশঙ্কায় আতঙ্কি হয়ে পড়েছে চরাঞ্চলসহ নি¤œাঞ্চলের মানুষজন। নি¤œাঞ্চলের সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের শুলকুর বাজার এলাকার কৃষক আহমেদ আলী জানান, কয়েক দিন ধরে বৃষ্টিপাতের ফলে খাল বিল সব ভরে গেছে। এ দিকে ধরলার পানিও দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে বাড়ির পাশে অবস্থান করছে। যেকোনো সময় পানি বাড়িতে উঠতে পারে। পটল ক্ষেত, ঢেড়স ক্ষেত, পাট ক্ষেতসহ বিভিন্ন সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে।

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মোল্লারহাট এলাকার মতিয়ার রহমান জানান, ব্রহ্মপুত্রের পানি খুবই দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন চরগুলোতে পানি প্রবেশ করছে। এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে চরাঞ্চলের ঘরবাড়ি নিমজ্জিত হয়ে পড়বে। আমরা খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছি।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন জানান, জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত সব নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও এখনো বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে আগামী ২২ ও ২৩ জুন এসব নদনদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে আবহাওয়ার পুর্বাভাস অনুযায়ী জানতে পেরেছে। তবে আগামী ১০ দিনের মধ্যে বড় কোনো বন্যার সম্ভাবনা না থাকার কথাও জানান তিনি।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/756791