৫ জুন ২০২৩, সোমবার, ৫:৪৪

দুর্বিষহ জনজীবন

সারাদেশে তীব্র গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং। এতে বিপর্যস্ত জনজীবন। গরম আর লোডশেডিংয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে মানুষ। লোডশেডিংয়ের কারণে মানুষ রাতে ঘুমাতে পারছে না। কালকারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। দিনে ঘন্টায় ঘন্টায় বিদুৎ যাচ্ছে এতে করে কারখানায় মেশিনের চাকাই ঘুরছে না। প্রচন্ড গরমের কারণে মানুষ দিনের বেলায় কাজে যেতে পারছে না। এতে নির্মাণ শিল্প ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। শ্রমিকরা অল্প সময় কাজ করে হাঁপিয়ে পড়ছে। কৃষি খাতেও এর প্রভাব পড়ছে। কৃষি জমিতে শ্রমিকরা প্রখর রোদে বেশিক্ষণ কাজ করতে পারছে না। এ ছাড়া শিশুরা স্কুলে যেতে পারছেনা। বিদ্যুৎ না থাকায় স্কুলে গিয়ে গরমে তারা প্রচন্ড কষ্টের মধ্যে পড়তে হয়। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ বিষয়টি বিবেচনা করে সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করেছে। এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ লেটার্স জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে প্রচ- গরমের এমন প্রতিকূল আবহাওয়া বা হিউমিড হিটের কারণে যেসব দেশ শ্রম ও উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে, এমন শীর্ষ পাঁচ দেশের কাতারে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। আবহাওয়ার এমন বিরূপ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ প্রতি বছর ৩২০০ কোটি কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে।

জামালপুর থেকে আসা মো. আব্দুল জব্বার গত ১৪ বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালান। সপ্তাহে ছয়দিন তিনি দৈনিক সাত থেকে ১২ ঘণ্টা রিকশা চালিয়ে থাকেন। কিন্তু এ বছর এ সময়ে যে গরম তাতে তার রিকশা চালাতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, মাথার উপরে ধরেন এমন তাপ, গামছা প্যাচাইয়া দিলেও মাথা গরম অইয়া যায়। ঘাম হইতে থাহে খালি। এক’দুইডা ক্ষেপ মারার পর শইল কাহিল অইয়া পড়ে। কিছুক্ষণ জিরানি (বিশ্রাম) ছাড়া আর চালানি যায় না। আগে যেখানে দিনে টানা ১০ থেকে ১২টা ক্ষেপ মারতাম অহন এই গরমে তা আর পারি না। তাই আয়ও অনেক কম অয়। গরমে গাছের নিচে বইলে ঘুমেও ধরে।

গরমের তীব্রতা বেড়েই চলছে। দেশের তাপমাত্রা ইতোমধ্যে ৪০ ডিগ্রী ছাড়িয়ে গেছে। গত দু’দিন আগে দিনাজপুরে সর্বোচ্চ ৪১ ডিগ্রী তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে তীব্র এবং মাঝারি তাপপ্রবাহ বইছে। এ অবস্থা লোডশেডিংও বেড়েই চলছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে প্রতি ঘন্টায় বিদ্যুৎ যাচ্ছে। অন্য দিকে গ্রামের মানুষ দিনে ২৪ ঘন্টার মধ্যে মাত্র ৩ থেকে ৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছে। সব মিলিয়ে গরম আর লোডশেডিংয়ে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

এই লোডশেডিংয়ের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল দু:খপ্রকাশ করে বলেছেন, বর্তমানে প্রায় ১৭০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং চলছে। ফলে মানুষের দুর্ভোগ হচ্ছে। এ কারণে আমরা দুঃখিত। জ্বালানি সংকটের কারণে আগামী ৫ জুনের পর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। জ্বালানি কয়লা আমদানি করতে আরও অন্তত ২০-২৫ দিন সময় লাগবে।
বাড়ধানীতে গত কয়েকদিন ধরে প্রতি ঘন্টায় লোডশেডিং হচ্ছে। গতকাল সকাল থেকেই বিভিন্ন এলাকায় এক ঘণ্টা পরপর বিদ্যুৎ যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে গতকাল ভোর পর্যন্ত বার বার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় গরমে মানুষের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। অনেকেবই বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থায় ফোন করে অভিযোগ জানাচ্ছেন। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হচ্ছে না। দফায় দফায় লোডশেডিং আর প্রচন্ড গরম দুর্বিষহ করে তুলেছে জনজীবন।

এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠা ছোট ছোট কারখানাগুলো লোডশেডিংয়ের কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ঘন্টায় ঘন্টায় লোডশেডিং হওয়ার কারণে তারা মেশিন চালু করতে পারে না। এ জন্য তাদের উৎপানও প্রায় বন্ধ রয়েছে বলা যায়।
রাজধানীর মগবাজারে দরজা- জানালার গ্রীল তৈরী করে ভাই ভাই ইনঞ্জিনিয়ারিং। এর মালিক সাইদুল ইসলাম বলেন, গত প্রায় পনের দিন ধরে অস্বাভাবিক হারে লোডশেডিং শুরু হয়েছে। দিনে রাতে সব সময়ই লোডশেডিং থাকছে। এতে আমাদের কাজের খুবই ক্ষতি হচ্ছে। যে কাজ দু’দিনের মধ্যে ডেলিভারি দেওয়ার কথা সে কাজ ১ সপ্তাহেও দিতে পারছি না।

রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার গৃহিনী রোকসানা আক্তার বলেন, এই গরমের মধ্যে যে ভাবে ঘন্টায় ঘন্টায় কারেন্ট যায় তাতে জীবন একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে আমার বাসার ফ্রিজ এবং এসি নষ্ট হয়ে গেছে। এখন কিযে দুর্বিষহ কষ্টে মধ্যে পড়েছি তার আর কি বলবো। এ অবস্থার কবে যে শেষ হবে তা আল্লাই জানে।

শুধু রাজধানী নয়, ময়মনসিংহ, খুলনা, রাজশাহীর বিভিন্ন গ্রামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। ঢাকার আশপাশের এলাকাতেও তিন থেকে চার ঘণ্টার লোডশেডিংয়ে ভুগছে মানুষ। দুই বিতরণ সংস্থা বলছে, চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি সমন্বয় করতে নিয়মিত লোডশেডিং করতে হচ্ছে। প্রায় ১ সপ্তাহ ধরে বয়ে চলা তাপপ্রবাহের কারণে গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ। এতে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। কিন্তু জ্বালানির অভাবে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। তাই গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোডশেডিং। ভোগান্তিতে পড়েছে মানুষ।

আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, ৮ অথবা ৯ জুন বিচ্ছিন্নভাবে বৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ ৭ জুন পর্যন্ত দেশের তাপমাত্রা বেশি থাকার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বেহাল দশা। কয়লার অভাবে পায়রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বিঘিœত হচ্ছে। আগামীকালের পর পায়রায় পুরোপুরি উৎপাদন বন্ধ হতে পারে। এতে লোডশেডিং আরও বাড়তে পারে। কয়লার অভাবে এখন উৎপাদন হচ্ছে সক্ষমতার অর্ধেকের চেয়ে কম। ৬০০ মেগাওয়াট করে উৎপাদন করছে কেন্দ্রটি। বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গরম না কমায় বিদ্যুৎ পরিস্থিাতিরও আরও অবনতি হয়েছে। চাহিদা যত বাড়ছে, ঘাটতিও তত বাড়ছে।

তীব্র তাপদাহ এবং ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে ব্যহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম। এই গরমে স্কুল-কলেজ-মাদরাসাগামী শিক্ষার্থীদের অনেকটা হাসফাঁস অবস্থা, অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে। আর যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিন শেডের সেগুলোতে ক্লাস-পরীক্ষা চালিয়ে নেয়া দুরুহ হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। তারা বলেন, গরমের কারণে সকাল থেকেই উত্তপ্ত হয়ে থাকছে ক্লাসরুমগুলো। এর মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই থাকছে না বিদ্যুৎ তখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবস্থা ঘেমে- নেয়ে একাকার হয়ে যায়। সরকার এটি বিবেচনায় নিয়ে অবশেষে সরকার প্রাইমারি স্কুলের ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করেছে।

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বাশিস) সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি বলেন, গরম ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে ক্লাস চালানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখনই লোডশেডিং হয় তখন শিক্ষার্থীরা বিশৃঙ্খলা শুরু করে, কন্ট্রোল করা যায় না। আবার অনেকেই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে চলে যায়।

তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। বাংলাদেশেও বন্যার সময় এই সিদ্ধান্ত নেয় হয়। চলমান তাপদাহও একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মানুষ তীব্র রোদ আর তাপের কারণে ঘরেও টিকতে পারছে না, সেখানে স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়া করা, ক্লাস করা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য কঠিন হয়ে যায়। তাই সরকার কিছুদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কথা চিন্তা করতে পারে। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালীন যে ছুটি হয় সেটি কিছুদিন এগিয়ে আনার বিষয়ে বিবেচনায় নিতে পারে।

ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলা পর্যায়ে বিদ্যুতের ভয়াবহ বিপর্যয় চলছে। গভীর রাত পর্যন্ত চলছে লোডশেডিং, একারণে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করতে পারছে না, গরমের কারণে রাত জেগে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। আবার সকাল বেলা প্রচ- রৌদ্রের মধ্যে স্কুল-কলেজে যেতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনিহা তৈরি হচ্ছে। প্রায়ই দিনেই বেশ কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকছেন, অনেকেই গরমের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

গত ২৯ মে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলতে নেমে হিটস্ট্রোকে ছুনুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী রিয়া আক্তার হিটস্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করে। অনেক অভিভাবকই তাদের সন্তানদের অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা জানাচ্ছেন। অনেকেই আবার গরমের কারণে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন না। এমন পরিস্থিতিতে কিছুদিনের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবি জানিয়েছেন তারা।

প্রচ- গরমে শিশুদের কি ধরণের সমস্যা হয় জানতে চাইলে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মো. রিদওয়ানুল ইসলাম বলেন, এই ধরণেল অবস্থায় শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। কারণ প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের শরীরে পানির পরিমাণ বেশি থাকে। তাই তাদের পানিশূণ্যতা, লবণের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। অনেক সময় হিটস্ট্রোকের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এসময় তাদের মাথা ব্যাথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। এজন্য শিশুদেরকে বেশি পরিমাণে পানি, ফলের জুস, খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। কোনভাবেই 

রৌদ্রে নেয়া যাবে না। এছাড়া কোন সমস্যা হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। https://dailyinqilab.com/national/article/578797