৪ জুন ২০২৩, রবিবার, ১১:২৬

দক্ষতার অভাবে পিছিয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকরা

জাপানে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক বিদেশি শ্রমিক গেলেও দক্ষতার অভাবে পিছিয়ে আছেন বাংলাদেশের শ্রমিকরা। জাপানি ভাষা ও পেশাগত দক্ষতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারায় দেশটিতে যেতে পারছেন না বেশির ভাগ শ্রমিক।
জাপানি ভাষা শেখা ও পেশাগত দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে দেশে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া পাঠানোর প্রক্রিয়ায় পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে অনেক সময় নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যায়।

এসব কারণে জাপান গমনেচ্ছুদের মধ্যে মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
জাপানের স্বাস্থ্য ও শ্রম কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে জাপানে ১৮ লাখ ২২ হাজার ৭২৫ জন বিদেশি শ্রমিক যান। সেখানে বাংলাদেশ থেকে গত ২৩ বছরে মাত্র দুই হাজার ৭৪০ জন জাপান গেছেন বলে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সূত্রে জানা যায়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত গেছেন মাত্র ২৬৩ জন।

জাপান যাওয়ার যোগ্যতা : জাপান যেতে হলে প্রথমে একজন কর্মীকে দেশটির ভাষা শিখতে হয়। এই ভাষা শেখার জন্য বিএমইটির ৩৫টি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে (টিটিসি) প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অর্ধেক কেন্দ্রেই জাপানি ভাষা শেখানোর শিক্ষক নেই।

বিএমইটির কর্মকর্তারা বলছেন, জাপানি ভাষা শেখানোর জন্য তেমন শিক্ষক পাওয়া যায় না।
এই ভাষা শেখানোর জন্য সরকারি কোনো পদও নেই। তাই তাঁরা অস্থায়ীভাবে এসব কেন্দ্রে জাপানি ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা করে আসছেন।

জাপান যেতে কর্মীদের দক্ষতাবিষয়ক বিশেষ পরীক্ষা (এসএসডাব্লিউ) দিতে হয়। বাংলাদেশি কর্মীদের গত বছর পর্যন্ত এই পরীক্ষা দিল্লিতে গিয়ে দিতে হয়েছে। এতে একসঙ্গে অনেক কর্মীকে দিল্লি পাঠিয়ে পরীক্ষা দেওয়ানোর সক্ষমতা ছিল না বিএমইটির।
চলতি বছর এই পরীক্ষার কেন্দ্রটি রাজধানীর ধানমণ্ডিতে স্থাপন করতে পেরেছে তারা।

বিএমইটির কর্মকর্তারা বলছেন, পরীক্ষার কেন্দ্রবিষয়ক সমস্যা যেহেতু মেটানো গেছে, এখন কর্মী পাঠানোর গতিও বাড়বে।
তবে জাপান যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে এখনো সে রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে কৃষি ও নার্সিং সেবা খাতের জন্য জাপানি সিলেবাস অনুযায়ী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পেরেছে বিএমইটি। এ ছাড়া উৎপাদন, বিপণন, হোটেল-রেস্তোরাঁ, নির্মাণ খাত, শিক্ষা সহায়ক, তথ্য-প্রযুক্তি, চিকিৎসাসেবা ও বিশেষায়িত খাতগুলোর জন্য এখনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারেনি তারা। এ কারণে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জাপান যেতে পারছেন না।

জাপান যাওয়ার প্রক্রিয়া : জাপানের কম্পানিগুলোর কাছ থেকে কর্মীর চাহিদা পাওয়ার পর বেশ কিছু ধাপ পেরিয়ে একজন বাংলাদেশি কর্মী জাপান যেতে পারেন। এতে প্রায় এক বছরের মতো সময় লেগে যায়। প্রথমে কম্পানিগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলো চাহিদাপত্র সংগ্রহের কাজ করে। এরপর আগ্রহী কর্মীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রাথমিক বাছাই সম্পন্ন করে। এরপর কর্মীদের জাপানি ভাষা শিখতে হয়। পরে তাঁদের ভাষার ওপর পরীক্ষা দিতে হয়। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই কেবল এসএসডাব্লিউ পরীক্ষা দেওয়া যাবে। টেকনিক্যাল ইন্টার্ন হিসেবে কেউ জাপানে কাজ করতে চাইলে তার জন্য এসএসডাব্লিও পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না।

পুরো কার্যক্রম শেষ হতে ছয় থেকে আট মাস লেগে যায়। এরপর জাপানে বাংলাদেশ দূতাবাসের সত্যায়ন লাগে। এখানে দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগে বলে জানায় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জাপানি কম্পানিগুলোর চাহিদামতো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শ্রমিক পাঠানো সম্ভব হয় না। শুধু নির্ধারিত সময় নয়, যথাযথ দক্ষতা না থাকার কারণেও চাহিদামতো কর্মী পাঠাতে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো।

এ ব্যাপারে গ্লোবাল রিত্রুদ্ধটিং এজেন্সির মালিক সবুর খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অন্যান্য দেশের তুলনায় জাপানে কর্মী পাঠানোর পক্রিয়াটা ভিন্ন। জাপানি কম্পানিগুলো আগে আমাদের এখানকার কোম্পানি সিলেক্ট করবে, এরপর তারা চাহিদাপত্র নিশ্চিত করবে। এ চাহিদাপত্র নিশ্চিত হওয়ার পর অনেক ধাপ পার করে কর্মীরা জাপান যেতে পারেন। জাপান যেহেতু সব কিছু যাচাই-বাছাই করে কর্মী নিয়ে থাকে, সে জায়গায় বাংলাদেশ যদি তাদের সত্যায়নের প্রক্রিয়া সহজতর করতে পারে, তাহলেই কর্মী পাঠানোর বিষয়টি গতি পাবে।’
রিত্রুদ্ধটিং এজেন্সি ছাড়াও জাপানি একটি সামাজিক সংগঠন আই অ্যাম জাপানের মাধ্যমে জাপানে কর্মী পাঠায় বিএমইটি। জাপানি ভাষা শেখার প্রতি সরকার গুরুত্ব আরোপ করলেই শ্রমবাজারে গতি বৃদ্ধি পাবে বলে জানান আই অ্যাম জাপানের বাংলাদেশি প্রতিনিধি গোলাম কিবরিয়া। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যেসব জায়গায় জাপানি ভাষার ট্রেনিং দেওয়া হয়, সেসব জায়গায় আরো দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। আমরা যদি ভাষার প্রতি আরো বেশি যত্নবান হতে পারি, তখন জাপান যাওয়ার গতি আরো বাড়বে।’
জাপানে কর্মী পাঠানোর গতি বৃদ্ধির কার্যক্রম অব্যাহত আছে বলে জানান বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক শহীদুল আলম। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘চলতি বছর ঢাকায় এসএসডাব্লিউর সেন্টার বসিয়েছি।

কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। কিন্তু একটা সমস্যা হচ্ছে, জাপানি ভাষা শেখার কোনো শিক্ষক পাওয়া যায় না। আমাদের চেষ্টা রয়েছে জাপানি ভাষা জানা শিক্ষক দিয়ে অস্থায়ীভাবে জাপানি ভাষা শেখানোর।’

আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর হলেই জাপানসহ অন্যান্য শ্রমবাজারে কর্মী যাওয়ার গতি ফিরবে বলে জানান ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মীরা শুধু জাপান নয়, বিভিন্ন জায়গায় যদি দক্ষ হয়ে যেত, তাহলে তারা প্রতারণার শিকার হতো না। পাশাপাশি আমাদের সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন ধরনের প্রচরণা দরকার।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/06/04/1286504