২৯ মে ২০২৩, সোমবার, ১২:০৫

চাপ সৃষ্টি করছেন বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা

কর ছাড়, ভর্তুকি মূল্যে জ্বালানি, উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ (রেন্টাল ভাড়া), প্রকল্পের জমি, ঋণ গ্রহণে সহযোগিতাসহ সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছেন বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের (আইপিপি) মালিকরা। তিন-পাঁচ বছর মেয়াদি ব্যয়বহুল ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর চুক্তির মেয়াদ একাধিকবার বাড়িয়েছে সরকার। এর পর সরকারের কাছ থেকে আরও সুবিধা চাইছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সংগঠন বিপ্পা (বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন)। তারা ফার্নেস অয়েলের আমদানি শুল্ক কমানো ও বকেয়া বিলের ওপর সুদ দাবি করেছে। ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের ওপর ১০-১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের দাবি করেছে তারা। এর আগে ডলারের দর বৃদ্ধির আবদার করেন বেসরকারি মালিকরা। এমনিতেই ডলার সংকটে বিপাকে আছে সরকার। এদিকে বেসরকারি বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরাও সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করছেন।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বিদ্যুৎ খাতে গত এক দশকে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বেড়েছে। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেক বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে। গত এক যুগে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকরা শুধু ভাড়া হিসেবেই সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন ১ লাখ কোটি টাকা। এখন বকেয়ার ওপর সুদ দিতে গেলে সরকারের খরচ আরও বাড়বে। যেহেতু বেসরকারি কেন্দ্রের বিল ডলারে দিতে হয়, তাই এমন সুযোগ সরকারের ডলার সংকট আরও বাড়িয়ে দেবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম সমকালকে বলেন, নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সরকারঘনিষ্ঠ বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পকেট ভারী করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই ক্যাপাসিটি চার্জের নামে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। রেন্টাল, কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের মেয়াদ বারবার বাড়ানো হয়েছে। এর পরও ব্যবসায়ীরা সুযোগ চাচ্ছেন। এসব অযৌক্তিক দাবি মানা কখনোই উচিত হবে না। ব্যবসায়ীদের দাবি মানলে তার চাপ গিয়ে পড়বে ভোক্তাদের ওপর।

গত ৯ মে এক চিঠিতে বিপ্পা পিডিবিকে বকেয়া, সুদসহ ঝুলে থাকা ইস্যুগুলো দ্রুত সমাধানের দাবি জানিয়েছে। না হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বিঘ্নিত হয়ে লোডশেডিং পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে বলে সরকারকে সতর্ক করেছে। কারণ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিচালনার সর্বশেষ পুঁজি জ্বালানি ফুরিয়ে আসছে।

বিপ্পা সভাপতি ও সামিট গ্রুপের পরিচালক ফয়সাল খান সমকালকে বলেন, ছয়-সাত মাসের বিল বকেয়া রয়েছে। অর্থ সংকটে তেল আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ৩০ দিনের বিল ১৮০ দিনেও পাওয়া যাচ্ছে না। দেরি করে বিল পাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে। কারণ ডলার বেশি দামে কিনতে হয়। বেসরকারি মালিকরা বিলম্বে বিলের কারণে ৪ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছেন। শুধু সামিট পাওয়ারের লোকসান হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। লোকসান পোষাতে সুদ চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পিপিএতে বিল বকেয়া হলে সুদের কথা বলা আছে। ফয়সাল খান বলেন, পিডিবি সংকটে আছে এটা ঠিক, তবে বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদেরও তো ব্যবসা করতে হবে।

আমদানি করা জ্বালানিতে সমহারে ২২ শতাংশ ট্যাক্সের বিষয়ে ফয়সাল খান বলেন, এতে এনবিআরের রাজস্ব আদায় বাড়বে। এ ছাড়া ট্যাক্স বাদে ফার্নেস অয়েল বা কয়লায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ সমান। শুধু ট্যাক্স বেশি হওয়ায় ফার্নেসের খরচ বেশি পড়ে। ফলে পিডিবির উৎপাদনের মেরিটলিস্টে ফার্নেস অয়েলের কেন্দ্রগুলো পিছিয়ে পড়ে। ট্যাক্স সমান হলে সবার রিয়েল কস্টে মেরিট লিস্ট তৈরি হবে।

বিপ্পার সাবেক সভাপতি ও কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম বলেন, দেশের বিদ্যমান আইন মেনেই বকেয়া বিলের ওপর সুদ চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তাঁরা ইতিবাচক বলেই এত লোকসানের মাঝেও সরকারকে বিদ্যুৎ দিয়ে যাচ্ছেন। পিডিবি সুদ দিতে চাইছে না। এর বিপরীতে যদি এলসি নিয়ে ক্লেইম করা হয়, তাহলে বিষয়টা কারও জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিদেশে অবস্থান করছেন। হোয়াটসঅ্যাপে কল ও টেক্সট করা হলেও উত্তর পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমানও কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

জ্বালানির আমদানি শুল্ক ২২ শতাংশ
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা আমদানি করা জ্বালানির ওপর শুল্ক সমান করার দাবি জানিয়েছেন। গত ১২ এপ্রিল বিপ্পার সভাপতি ফয়সাল খান বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে লেখা এক চিঠিতে কয়লা, গ্যাস (এলএনজি) এবং ফার্নেস অয়েলের ক্ষেত্রে একই হারে ২২ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের দাবি জানান। সংগঠনটির দাবি, এতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে এবং জ্বালানিভেদে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচের মধ্যে বৈষম্য কমবে। বর্তমানে এলএনজির ওপর আমদানি শুল্ক ২২ শতাংশ, কয়লার ওপর ৫ শতাংশ এবং ফার্নেস অয়েলের ওপর ৩৪ শতাংশ। বিপ্পার দাবি, আমদানি শুল্ক সমহারে আরোপ করলে ২০৩০ পর্যন্ত সরকারের ১৮ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় হবে।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিপ্পার দাবি মানলে মূলত ফার্নেস অয়েলের শুল্ক কমবে; বাড়বে কয়লার আমদানি ব্যয়। তাঁরা বলছেন, বেসরকারি মালিকরা অনেক দিন থেকে ফার্নেস অয়েলের শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন। সমহারে আমদানি শুল্ক আরোপ হলে তাঁদের সেই দাবিই মানা হবে। আইপিপির অধিকাংশই ফার্নেস অয়েলচালিত। ফার্নেস অয়েলচালিত প্রায় ৫০টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট। আমদানি কয়লায় চালিত কেন্দ্রের সংখ্যা এখন পর্যন্ত চারটি; উৎপাদনক্ষমতা ২ হাজার ১৬৭ মেগাওয়াট।

বিপ্পার মতে, বর্তমান আমদানি শুল্ক হারে গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় ইউনিটপ্রতি (কিলোওয়াট-ঘণ্টা) ১৩-১৪ টাকা, কয়লায় ১৩-১৪ টাকা এবং ফার্নেসে ১৫-১৬ টাকা। সমহারে শুল্ক ধরলে (২২ শতাংশ) এই দর হবে যথাক্রমে ১৩-১৪, ১৫-১৬ টাকা ও ১৩-১৪ টাকা।

ভারতের বিদ্যুতে ১০-১৫ শতাংশ শুল্ক
বিপ্পা তার চিঠিতে বলেছে, বর্তমানে ভারত থেকে আনা বিদ্যুৎ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু দেশীয় কোম্পানিগুলোর জ্বালানির ওপর আমদানি শুল্ক রয়েছে। এতে দেশের বিদ্যুৎ উদ্যোক্তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এ বৈষম্য দূর করতে বিপ্পা ভারত থেকে আনা বিদ্যুতের ওপর ১০-১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের দাবি জানিয়েছে।

ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনা হচ্ছে। পাশাপাশি দেশটির আদানি গ্রুপের ঝাড়খন্ড কেন্দ্রের একটি ইউনিট থেকে ৫০০-৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে গত মাস থেকে।

বকেয়া বিলে সুদ
আইপিপিগুলো থেকে কেনা বিদ্যুতের বিল ৪৫ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হয় পিডিবিকে। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে সময়মতো ভর্তুকি না পাওয়ায় ছয় মাসেও বেসরকারি মালিকদের টাকা দিতে পারছে না সংস্থাটি। বিপ্পা জানিয়েছে, গত নভেম্বর থেকে বিল বকেয়া রয়েছে। পিডিবির তথ্য, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বকেয়া পড়েছে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। বিপ্পা এই বকেয়া টাকার ওপর সুদ বাবদ প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা দাবি করেছে। যদিও পিডিবি বলছে, পিপিএ (বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি) অনুসারে বিলম্বে বিল প্রদানের জন্য সুদ পরিশোধের নিয়ম নেই।

বিপ্পার পাশাপাশি বিলের ওপর সুদ দাবি করে পিডিবিকে চিঠি দিয়েছে কনফিডেন্স পাওয়ার, সামিট পাওয়ার, ঢাকা সাউদার্ন পাওয়ারসহ (ডরিন গ্রুপ) আরও কিছু কোম্পানি। বগুড়া-২ কেন্দ্রের বকেয়া বিলের জন্য ৭.৬৯ থেকে ৮.৬৮ শতাংশ হারে সুদ দাবি করেছে কনফিডেন্স পাওয়ার। গত নভেম্বরে দেওয়া চিঠিতে কোম্পানিটি বকেয়া বিলের জন্য সুদ হিসেবে ১১ কোটি ১১ লাখ টাকা দাবি করেছে। ঢাকা সাউদার্ন পাওয়ারের ৫৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রের গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা বাড়তি চেয়ে সুদ দাবি করেছে ডরিন গ্রুপ। সামিট পাওয়ার গাজীপুরের ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৮৫ কোটি ৭১ লাখ কোটি টাকা চেয়েছে।

জরিমানা মাফ পাচ্ছে
পিপিএ অনুসারে, চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ দিতে না পারলে (এক্সেস আউটেজ) বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে একটি নির্দিষ্ট হারে জরিমানা করে পিডিবি। গত বছর বিপ্পা পিডিবিকে চিঠি দিয়ে দাবি করে, ‘পিডিবি সময়মতো বিল পরিশোধ করতে না পারায় এবং ডলার সংকটের কারণে তারা সময়মতো এলসি খুলতে পারছে না। ফলে ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে পারছে না। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এক্সেস আউটেজজনিত জরিমানা মওকুফের দাবি জানায় বিপ্পা। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোর এক্সেস আউটেজজনিত জরিমানা গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সাময়িকভাবে স্থগিত রাখে পিডিবি। এপ্রিল মাসের বোর্ড সভায় এই সময়সীমা চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

ডলারের দর বৃদ্ধির দাবি
পিপিএ অনুসারে জ্বালানি তেল আমদানির মূল্য ডলারে পরিশোধ করে পিডিবি। চুক্তিতে প্রতি ডলারের জন্য মূল্য ধরা হয়েছে ৮৫ টাকা। কয়েক মাস আগে বিপ্পা দাবি করে, ফার্নেস অয়েল আমদানির জন্য প্রতি ডলার কিনতে তাদের ব্যয় হচ্ছে ১০৫ টাকা। পিডিবি ডলার দিচ্ছে ৮৫ টাকা দরে। এতে তাদের লোকসান হচ্ছে। বিপ্পা ৯৫ টাকা ৫ পয়সা দর অনুযায়ী ডলারের মূল্য পরিশোধের দাবি করে। এ বিষয়ে পিডিবি বিদ্যুৎ বিভাগের মতামত ও অর্থ বিভাগের অনুমোদন চায়। কারণ এই দাবি মানতে হলে পিপিএ সংশোধন করে সম্পূরক চুক্তি করতে হবে। তবে অর্থ বিভাগ বিষয়টি অনুমোদন করেনি বলে জানা গেছে।

https://samakal.com/bangladesh/article/2305175170