২৬ মে ২০২৩, শুক্রবার, ৭:৪৪

টক অব দ্য পলিটিক্স

ওয়াশিংটনে পার্টনারশিপ ডায়ালগেই মার্কিন ভিসায় কড়াকড়ি আরোপ করে জারি করা স্বতন্ত্র নীতির কথা জানানো হয় বাংলাদেশকে। বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসেবে সমুদয় কর্মসূচি শেষে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন স্টেট ডিপার্টমেন্টে ওই পার্টনারশিপ বৈঠকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাতে মার্কিন প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড। প্রতিনিধিদলে ছিলেন এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডনাল্ড লু’সহ অন্য কর্মকর্তারা। সেগুনবাগিচার দাবি পার্টনারশিপ বৈঠকের সাইড লাইনে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বাংলাদেশকে বিষয়টি জানানো হয়। এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক বা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি। কারণ এটি আলোচনায় নয় বরং একতরফাভাবে মার্কিন নীতি হিসেবে প্রণীত, যা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিক উদ্বেগের প্রেক্ষিতে খড়্গ হয়ে দেখা দেয়।

২০২১ সালে স্টেট ডিপার্টমেন্টের তরফে কঠোর ওই ভিসা নীতি আরোপ শুরু হয়। এ পর্যন্ত নাইজেরিয়া এবং সোমালিয়ায় এটি কার্যকর হয়েছে। দুর্ভাগ্য, তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এটি প্রয়োগ করলো ডেমোক্রেটিক বাাইডেন প্রশাসন। অবশ্য পরপর দুটি গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশের আমন্ত্রণ না জানানো এবং ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন উত্থাপনের প্রেক্ষাপটে ‘খড়্গ’ নামার আশঙ্কা করছিলেন বিশ্লেষকরা।

কিন্তু এটি যে বিস্তৃত পরিসরে আসবে তা অন্তত কেউ অনুমান করেছিলেন বলে এখনো দাবি করেননি! অবশ্য সেগুনবাগিচা বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাবশালী এক উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ জানাতে মার্কিন প্রতিনিধি বৈঠক করেছেন মর্মে খবর চাউর হয়েছিল। সেখানে মূলত ওই ভিসার ওপর কড়াকড়ি আরোপ বিষয় নতুন নীতির কথাই ইঙ্গিত করা হয়েছিল।
সেগুনবাগিচা বলছে, মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ভিসা নীতি নিয়ে ব্রিফ করতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অ্যাপয়েনমেন্ট চাচ্ছিলেন। কিন্তু মন্ত্রী কোভিড আক্রান্ত হওয়া এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে কাতার যাওয়ার কারণে অ্যাপয়েনমেন্টে দেরি হয়েছে। যা ঘটনাচক্রে ঘোষণার পরদিন বৃহস্পতিবার হলো। উল্লেখ্য, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাল দাবি করেছেন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিনকেন তাকে চিঠি দিয়ে আগেই এটি জানিয়েছেন। সেগুনবাগিচা বলছে সেই ব্লিনকেনের চিঠিটি ঢাকায় বুধবারের ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা আগে, অর্থাৎ মঙ্গলবারের। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের ওই ভিসা নীতিটি ওয়াশিংটন সুবিধাজনক সময়ে প্রকাশ করবে বলে ঢাকাকে তা গোপন রাখার বার্তা দিয়েছিল বলে দাবি করেছে সেগুনবাগিচা। তবে ওই ঘোষণার গুঞ্জন আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল। বুধবার মধ্যরাতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন তা নিশ্চিত করেন। জানিয়ে দেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে নতুন মার্কিন ভিসা নীতির খবর। ছোট করে বললে যার মানে দাঁড়ায়, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে, গণতান্ত্রিক আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে যারাই বাধা হবে তারা মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বেন। কারা হতে পারেন তারা? সেটাও স্পষ্ট করা হয়েছে বিবৃতিতে। বলা হয়েছে, এর মধ্যে বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা বা কর্মচারী, সরকার সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইনপ্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। ক্যাটাগরি দেখেই বুঝা যায়, এটি অত্যন্ত বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এতে বিপুল মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। কেউ কেউ বলছেন, কারও বিরুদ্ধেই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়নি। আবার মনে হয়, সবাই নিষেধাজ্ঞার আওতায়।

গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্তের মধ্যে কোনো কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তাও স্পষ্ট করা হয়েছে বিবৃতিতে। এরমধ্যে রয়েছে, ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, সহিংসতার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং জনগণকে সংগঠিত হবার স্বাধীনতায় বাধা দেয়া, রাজনৈতিক দল, ভোটার, নাগরিক সমাজ বা গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার থেকে বিরত রাখা।

আপাতদৃষ্টিতে পুরো বিবৃতিতে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ঘিরে মার্কিন কঠোর অবস্থানই স্পষ্ট হয়েছে। আমরা মাঝে-মধ্যেই এ শিরোনাম ব্যবহার করি। এক্ষেত্রেও এটা বলা চলে, মেসেজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। বাংলাদেশের নির্বাচনে আমেরিকা কী চায়, কীভাবে চায় তা যেন অনেকটাই স্পষ্ট করা হয়েছে। সম্প্রতি নাইজেরিয়াতেও ভোটকেন্দ্রিক মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেখা গেছে। সেখানেও যারা অবাধ ভোটের পথে বাধা হয়েছেন তাদেরকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে। মার্কিন বিবৃতির আরেকটি অংশকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের ব্যাপারে এ ধরনের খোলামেলা কথা যুক্তরাষ্ট্র আগে কখনো বলেনি। বিশেষত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের কথা একেবারেই পরিষ্কার। বুধবার রাতে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের জনগণের জন্য আমাদের বার্তা হচ্ছে, আমরা আপনাদের পাশে আছি। আমরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে আছি এবং আপনাদের দেশে গণতন্ত্রকে সহায়তার জন্য আমরা এই নীতি ঘোষণা করছি। বাংলাদেশে যদি কেউ জনগণের ক্ষমতার ওপর হস্তক্ষেপ করতে চায়, তাদের এই বার্তা দেয়া হচ্ছে যে ওয়াশিংটন ঘটনার ওপর চোখ রাখছে, যাতে জনগণ ভরসা পায়। আমরা মনে করি, আইনের এই ধারা প্রয়োগের সামর্থ্যরে পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের কাছে এমন সংকেত পাঠানোও গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে আছি, আর আমরা অ্যাকশন নিতে প্রস্তুত।’

গত কিছুদিন থেকে বাংলাদেশ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর বক্তব্য দিয়ে আসছিলো। তবে মার্কিন ঘোষণার পর সে ধরনের প্রতিক্রিয়া আসেনি। বরং বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতিকে ইতিবাচকভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার ও অবস্থানকে যাতে কেউ জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, সেজন্য মার্কিন সরকারের ভিসা নীতি আমাদের প্রচেষ্টাকে সাহায্য করতে পারে।” পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে প্রায় একই ধরনের সুর রয়েছে।

মার্কিন ঘোষণার নানারকম তাফসির হবে এটা অস্বাভাবিক নয়। তবে আগামী নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশের ওপর যে ওয়াশিংটন সবসময় খেয়াল রাখছে সর্বশেষ ঘোষণায় এটা স্পষ্ট করা হয়েছে। এটি সবার জন্যই বার্তা। আন্তর্জাতিক দুনিয়ার জন্য ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠছে বাংলাদেশের নির্বাচন। সামনের দিনগুলোতে এটি আরও স্পষ্ট হবে। এদিকে মার্কিন ঘোষণার পর দেশের রাজনীতিতেও শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। নানা সমীকরণ ঘুরপাক খাচ্ছে। বলতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি এখন দেশের টক অব দ্য পলিটিক্স হয়ে উঠেছে।

https://mzamin.com/news.php?news=57312