২৬ মে ২০২৩, শুক্রবার, ৭:৪২

থমথমে, সর্বত্রই উৎকণ্ঠা

সচিবালয়-আদালতপাড়ায় কেউ বিরসবদনে, কারো মধ্যে উচ্ছ¡াস : উচ্চশিক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রে গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীরা আশাহত
এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। বাংলাদেশের ওপর মার্কিন বজ্রপাত! আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য নতুন ‘ভিসা নীতি’ ঘোষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি বিøঙ্কেন। এ ঘোষণার পর সারাদেশে শুরু হয় তোলপাড়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে বিতর্ক, আলোচনা, সমালোচনা, উচ্ছ¡াস-উদ্বেগের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে সাবেক ও বর্তমান প্রশাসনে কর্মরত আমলা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল এবং বিতর্কিত কর্মকর্তা, বিচারকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শুরু হয়েছে। গতকাল সচিবালয়ে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রত্যাহিক কাজ রেখে ‘মার্কিন ভিসা নীতি’ নিয়েই আলোচনা করছেন। তাদের সবার মধ্যে চিন্তার ছাপ। অনেকেই বিরসবদনে বসে রয়েছেন। প্রশাসনের কর্মকর্তারাই শুরু নয়, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সে শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলোতেও শুরু হয়েছে উদ্বেগ। তবে বিএনপি মার্কিন এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। আর যারা বর্তমান সরকারের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমগুলোতে আনন্দ-উচ্ছ¡াস প্রকাশ করছেন।


বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন এই নীতি যে ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে সেটা বুঝে গতকালই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, মাঠের বিরোধী দল বিএনপি, ‘সরকার পালিত বিরোধী দল’ জাতীয় পার্টির নেতারা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় ছুটে যান। তিন দলের নেতা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে ঢাকায় কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সংশ্লিষ্টদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নীতি কার্যকর হবে। যুক্তরাষ্ট্র সবসময় গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যে এই নতুন ভিসানীতি। ঢাকা থেকে প্রচারিত একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু জানিয়েছেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়া ব্যক্তিদের ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারি সরকারি ও বিরোধী দুই পক্ষের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য। বিরোধী পক্ষ সহিংসতা করলে তারাও যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না।

বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি বিøঙ্কেন জানিয়েছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, রাজনৈতিক দলগুলোর শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা দেয়া এবং রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমে মতামত প্রচার বাধা দেয়াকে যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় বাধা হিসেবে বিবেচনা করবে। আর বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তারা, সরকারপন্থী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যরা, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোও এই নতুন ভিসা নীতির আওতায় পড়বেন।

নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার সময় অ্যান্টনি বিøঙ্কেন জানিয়েছেন, গত ৩ মে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতির চিঠি বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছে। দীর্ঘদিন এই চিঠির খবর বাংলাদেশ সরকার প্রচার না করায় বাইডেন প্রশাসন এই চিঠি প্রকাশ করে। এ নিয়ে গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ওদের (যুক্তরাষ্ট্র) বিষয় আমরা কেন জনগণকে জানানো? ওনারাই জানাক। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর লুকোছাপ এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন এই বক্তব্যে পরিষ্কার ২০১৬ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাড়ে ৮১০ কোটি টাকা চুরি যাওয়ার খবর গোপন রেখে সে সময়ের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান দিল্লি সফরে যান। সেখানে সেমিনার করে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা করেন। বিদেশি গণমাধ্যমে খবর প্রচারের পর বাংলাদেশের মানুষ সে তথ্য জানতে পারে এতো বিপুল পরিমাণ টাকা চুরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ‘ভিসা নীতি’ ঘোষণার কাগজপত্র হাতে পেয়েও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সে খবর তিন সপ্তাহ লুকিয়ে রেছে বিভিন্ন বিভিন্ন দেশ সফর করে বেড়িয়েছেন। অথচ এই মার্কিন ভিসা নীতির খবর প্রচার হওয়ার পর বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের মাথায় যেন বাজ্রপাত ঘটেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর প্রশাসনের কর্মরত আমলা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, নিম্ন আদালতে কর্মরত বিচারক এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যখন উদ্বিগ্ন; তখন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নীতিতে আওয়ামী লীগ সরকার বিচলিত নয়’। ঢাকায় কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, আমরা যে ভিসা নীতি প্রকাশ করলাম, সেটি প্রধানমন্ত্রীর যে আগ্রহ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার, সেটিকে আরো শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাবে। সুতরাং তারা যেটি করেছে ভালো। তবে এই নীতি নিরপেক্ষ নির্বাচনে কার্যকর হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে’। কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি নিয়ে আমরা মোটেই চিন্তিত নই’। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপির খবর আছে। আমরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক নির্বাচন করব। নির্বাচনে কেউ বাধা দিতে এলে প্রতিহত করা হবে’। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা মুখে এসব কথাবার্তা বললেও প্রকৃত চিত্র ভিন্ন।

গতকাল সকালেই রাজধানীর গুলশানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বাসায় ছুটে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা। তাদের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় বৈঠকটি শুরু হয়ে শেষ হয় বেলা পৌনে ২টায়। পরে বৈঠকের ব্যাপারে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এক বার্তায় বলেন, ‘আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে এমন ব্যক্তিদের ভিসা সীমিত করতেই এই নতুন ভিসা নীতি প্রযোজ্য।’

পিটার হাসের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, সুচিন্তা ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান মো. এ আরাফাত, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, জাতীয় পার্টির মহাসচিব এডভোকেট মুজিবুল হক চুন্নু, প্রেসিডিয়াম সদস্য মেজর (অব.) রানা মোহাম্মদ সোহেল অংশগ্রহণ করেন।
মার্কিন ভিসা নীতির এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। গণমাধ্যমে এটাই এখন ব্রেকিং নিউজ। গণমাধ্যম, ফেসবুক, বøগ, টুইটার, ইউটিউব সর্বোত্রই আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল মার্কিন ভিসা নীতি। সরকারি অফিস-আদালত, হাট-মাঠ-ঘাট সর্বোত্রই এই আলোচনা ছিল সবার মুখে মুখে। গতকাল দিনভর সচিবালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি ও আধা সরকারি অফিসে ঘুরে এবং বিভিন্ন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সত্যিই তারা আতঙ্কিত, উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে আমলা, বিচারক, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক বেশি। তারা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র‌্যাবের ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। ওই কর্মকর্তারা তখন বিপদে পড়েছেন। এখন ভিসা নীতিতে বলা হয়েছে মার্কিন প্রশাসন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত সব কাজে যাকে বাধা মনে করবেন তার এবং তার পরিবারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবেন। শুধু তাই নয় নির্দেশ দাতাকে ভিসা নীতির আওতায় আনা হবে। প্রশাসনে কর্মরত ডিসি, এসপি, ওসি এবং আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা ২০১৪ সাল ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে সরকারের দায়িত্বশীলদের নির্দেশ পালন করেছে। চাকরি করলে নির্দেশ পালন করতে বাধ্য। এ ছাড়া গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশ ইস্যুতে ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টস্থ বিএনপির কার্যালয় থেকে যেভাবে সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের গ্রেফতার করে দড়িতে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেটাও ওপরের নির্দেশেই হয়েছে। এখন মার্কিন প্রশাসনের কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে কার ওপর ভিসা নীতি প্রয়োগ করে তা বোঝা মুশকিল। নিম্ন আদালতের বিচারকরা কল্পনাই করেননি তাদের নির্বাচন সংক্রান্ত কর্মকাÐের আওতায় আনা হবে। কারণ বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে প্রায় সোয়া ১ লাখ মামলা এবং কারণে অকারণে মামলা নেয়া হয়। তাদেও নতুন ভিসা নীতির আওতায় আনা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকতা বললেন, ডিসি এবং ইউএনওদের মধ্যে এখন ভয় ধরেছে তাদের কার্যক্রম মনিটর করে ভিসা নীতির আওতায় আনা হয় কিনা সে ভয়ে।

গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ঘুরে দেখা গেছে, প্রশাসনের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা উৎকন্ঠায় পড়ে গেছেন। প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিম্নপর্যন্ত কর্মচারীদের মধ্যে সারাদিন আলোচনা ছিল মার্কিন নতুন ভিসা নীতি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অতিরিক্ত সচিব বলেন, আসলে এ বিষয়টি দেশের জন্য ক্ষতি করবে। তবে যেসব কর্মকর্তা ও তার পরিবারে ছেলে-মেয়েরা লেখা পড়া করছেন এবং ব্যবসা করছেন তারা বেশি বিপদে করবেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, অর্থ বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ভ‚মি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ঘুরে প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিম্নপর্যন্ত কর্মচারীদের নিজেদের মধ্যে একই আলোচনা করতে দেখা গেছে।

দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে এমন ব্যক্তিদের ভিসা সীমিত করার মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণায় সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে লক্ষ্য করা গেছে উচ্ছ¡াস। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন-এমন আইনজীবীদের মাঝে লক্ষ্য করা গেছে ফুরফুরে ভাব। তবে এই নীতিকে বিরসবদনে উড়িয়ে দিয়েছেন সরকার সমর্থক আইনজীবীরা। মার্কিন ভিসা নীতির বিষয়টি ছিল ‘টক অব দ্য বার’। এই নীতির বর্তমানÑভবিষ্যৎ প্রভাব-পরিণতি নিয়ে আদালতের বারান্দায়, আইনজীবীদের হলরুম, কক্ষে কক্ষে চলেছে নানা বিশ্লেষণ। সমাজের শিক্ষিত, সচেতন ও অগ্রসর নাগরিক হিসেবে পরিচিত আইনজীবীদের মুখে মুখে ছিল বিষয়টি। কি হবে, কী হতে যাচ্ছে? পরবর্তী পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়ায়? বিচারপতি এবং বিচার বিভাগের ওপর কি ধরনের প্রভাব ফেলবে? চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন কি ধরণের রূপ পরিগ্রহ করবে? সরকারের সদা প্রস্বস্তি-মুখর সংবাদমাধ্যমগুলো এখন কি ভূমিকা নেবে? তারা নতুন কি কথা শোনাবে? মার্কিন এবং মার্কিন সমর্থক দেশগুলো বাংলাদেশ ইস্যুতে এখন কি ভ‚মিকা নেবে? বাংলাদেশের বিষয়টি প্রতিবেশী ভারত কীভাবে মূল্যায়ন করবে? বিরোধী মত দমনে ১৫ বছরের হামলা-মামলা, ভয়াবহ দুর্নীতি, ক্রমাগত পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে জনমত- কোন্দিকে গড়াবে-বিশ্লেষণ চলেছে চুল-চেরা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মোকছেদুল ইসলাম এ বিষযে বলেন, এই ভিসা নীতি বিচার বিভাগের জন্য এক অশনি সঙ্কেত। অতীতের অনেক জাস্টিস, চীফ জাস্টিস অগণতান্ত্রিক সরকার এবং এর কার্যক্রমকে বৈধতা দিয়ে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত এই পলিসি দিয়ে তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ভিসা আটকে দেয়া সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র যা করবে আইনের আওতায় নিয়েই করবে। বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন ভিসানীতির আওতায় আপনি-আমি যে কেউ পড়তে পারি। এটি জাতির জন্য কোনো ক্রমেই সুখবর নয়। স্যাংশন দিলেও ভালো ছিল। কারণ এতে স্যাংশনের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতো। কিন্তু এই ভিসা নীতির ফলে সবাই যেন সন্দেহের আওতায় চলে এলাম। এটি শুধু যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই ভিক্টিমাইজ হবেন তাই নয়। কোনো দল করেন না- এমন ব্যক্তিও পড়তে পারেন। এটি স্যাংশনের চেয়েও বড়।

এই ভিসা নীতিকে ‘অন্ধকার ঘরে সাপ ছেড়ে দেয়া’র সঙ্গে তুলনা করেছেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট মো: মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে আলোচনা হচ্ছিল নতুন মার্কিন স্যাংশন আসবে বলে। কোনো স্যাংশনই এলো না। কিন্তু এমন এক বিষয় এলো যা ধারণারও বাইরে। কারণ স্যাংশন হয়তো প্রযোজ্য হতো সুনির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির ওপর। কিন্তু মার্কিন এই ভিসা নীতি দিয়ে যাকে ইচ্ছে তাকেই আটকে দেয়া সম্ভব। বাংলাদেশের গণতন্ত্র কারও দ্বারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছেÑ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমনটি মনে হলেই হলো। তাকেই আটকে দেয়া যাবে। এটি অত্যন্ত ভয়াবহ। বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র-গত বুধবার রাতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি বিøঙ্কেনের এমন ঘোষণার পর গতকাল বৃহস্পতিবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের সর্বত্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এটি। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করা গেছে অনেক কর্মকর্তার মধ্যে। বৃহস্পতিবার অফিস শুরুর প্রথম থেকেই পুলিশ সদর দফতর, ডিএমপি, ডিবি ও সিআইডিসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের মধ্যে কি হবে বা কি হচ্ছে, এ নিয়ে চলে দিনভর আলোচনা। অনেরক কর্মকর্তা নিজের অফিসের গন্ডি পেরিয়ে অন্য সহকর্মীদের অফিসে গিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে দেখা গেছে। শুধু রাজধানী নয়, রাজধানীর বাইরে থেকেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা সহকর্মীদের কাছে জানতে চেয়েছেন কি হচ্ছে। এক কথায় গতকাল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি বিøঙ্কেনের এমন ঘোষণার পর গাজীপুরের নির্বাচনে ভোটের পরিবেশ কিছুটা পাল্টে গেল। কর্মকর্তাদের অনেকের মধ্যেই এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাঠ পর্যায়ের একজন পুলিশ সুপার ইনকিলাবকে বলেন, শীর্ষ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব পালন করছি। পেশাদার কর্মকর্তাদের মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি বিøঙ্কেনের এমন ঘোষণা নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া নেই বা থাকার কথা নয়। তবে অনেকেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন যে তাদের অতীত কর্মকাÐ মূল্যায়ন করে কোন পদক্ষেপ মার্কিন প্রশাসন নেয় কি-না।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা নিতে যুক্তরাষ্ট্র যান। করোনায় দু’বছর বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার হার কমে গেছেও গত বছর ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস বিশেষ উদ্যোগে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষায় আমেরিকা পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। সে উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষা নেয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। গত কয়েক মাসে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী আমেরিকা গেছেন উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের লক্ষ্যে। আরো কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষা নিতে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নীতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তারাও এই নতুন ভিসা নীতির কবলে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র যেতে পারবেন কি-না তা নিয়ে শঙ্কিত।

https://dailyinqilab.com/national/article/576698