২৫ মে ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:৫৬

একান্ত সাক্ষাৎকারে সদ্যবিদায়ি চেয়ারম্যান

ঢাকা ওয়াসায় -সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই

ঢাদোর্দণ্ডপ্রতাপশালী এমডি অটল থাকলেও চিঠি পাঠানোর পাঁচ দিনের মাথায় পদ হারিয়েছেন চেয়ারম্যান। এ বিষয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গোলাম মোস্তফার সঙ্গে অনলাইনে খোলামেলা আলাপ করেছেন যুগান্তরের বিশেষ প্রতিনিধি মাহবুব আলম লাবলু। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।

যুগান্তর : এমডির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ করে আপনার পদ হারানোর বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
গোলাম মোস্তফা : মন্ত্রণালয় কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটা করেছে, তা আমি বলতে পারব না। আমার টার্ম শেষ হয়ে গেছে, এ কারণে করেছে কি না-এটা আমি জানি না। তবে অভিযোগ পাঠানোর পরপরই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে হচ্ছে-এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাঠানোর কারণেই আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

যুগান্তর : মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে আপনি কী বলেছিলেন?
গোলাম মোস্তফা : চিঠিতে বলেছিলাম, ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান ওয়াসা আইন ভঙ্গ করে ব্যক্তিগত সম্পদের মতো স্বৈরাচারী কায়দায় ওয়াসা প্রশাসন পরিচালনা করছেন। ওয়াসাকে অনিয়ম, অপচয় ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন।

ওয়াসা বোর্ডকে অবমাননার বিষয়টি দীর্ঘদিন চলে এলেও বর্তমানে তা চরম পর্যায়ে পৌঁচ্ছে গেছে। বোর্ডকে এড়িয়ে সবকিছু করা হয়।
বোর্ডের সিদ্ধান্ত মানা হয় না। বোর্ড যেসব এজেন্ডা নিয়ে সভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত দিতে চায়, সেসব এজেন্ডা সভায় তুলতে বাধা দেওয়া হয়। বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে বোর্ড কমিটি করে দিলেও বাধার কারণে কমিটিগুলো কাজ করতে পারছে না।

যুগান্তর : ওয়াসার অনিয়ম-দুর্নীতি এবং এমডির স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ পুরোনো। কিন্তু আপনার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এসব নিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানোর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি?
গোলাম মোস্তফা : হঠাৎ মানে কী? আমরা তো দীর্ঘদিন ওনার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছি। বোর্ড সভায় আমরা আলোচনা করেছি। অনেক সময় তর্কবিতর্ক করেছি। কিন্তু তিনি আমাদের কথা শুনছেন না। দীর্ঘদিন ধরেই বোর্ড সদস্যরা ক্ষুব্ধ। বোর্ডে থেকে আমরা কোনো কাজ করতে পারছি না।

কোনো সিদ্ধান্তও দিতে পারছি না। সিদ্ধান্ত দিলেও সেটা মানা হচ্ছে না। আমাদের সিদ্ধান্ত দিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি তাকে বুঝিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করেছি।

যখন বুঝিয়ে ঠিক করতে পারলাম না, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম এখানে আর থাকব না। কারণ, এখানে থেকে কিছু করতে পারছি না। ভবিষ্যতেও পারব না। তবে মনে করলাম, বিষয়গুলো মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা দরকার। এ কারণেই আড়াই বছর পর অবহিত করেছি।

যুগান্তর : এমডি হিসাবে তাকসিম এ খান কী ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতিতে যুক্ত এবং বোর্ডকে এড়িয়ে তিনি কী কাজ করেছেন?
গোলাম মোস্তফা : একটা উদাহরণ দিই। গুলশানে ৫৫ নম্বর রোডে ঢাকা ওয়াসার একটা বহুতল ভবন হচ্ছে। ওখানে সাইনবোর্ডে বলা আছে ১৩ তলা ভবন। কিন্তু বোর্ড জানবে না, এটা হতে পারে না।

এই ভবনের প্ল্যান করার আগেই তা বোর্ডে উপস্থাপন করতে হবে। বোর্ডের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই ডিজাইন, কনস্ট্রাকশন, টেন্ডারসহ সব প্রক্রিয়া করা যাবে। তাতেও বোর্ডের অনুমোদন লাগবে।

কিন্তু বোর্ড এই ভবন নির্মাণের বিষয়ে কিছুই জানে না। তাহলে বুঝতেই পারছেন, তিনি কী ধরনের দুর্নীতিতে যুক্ত এবং কতটা স্বেচ্ছাচারী।

যুগান্তর : বোর্ডকে এড়িয়ে এমডি এভাবে সব করে যাচ্ছেন, তাহলে তার ক্ষমতার উৎস কোথায়?
গোলাম মোস্তফা : আমি এটা বলতে পারব না। জানলেও বলব না।
যুগান্তর : তাহলে কি ওয়াসা বোর্ড একেবারেই অকার্যকর?
গোলাম মোস্তফা : অকার্যকর তো বটেই। যেখানে ওয়াসা বোর্ড কোনো কিছুই করতে পারে না, তাকে আপনি কী বলবেন। এমডি সব সময় চান শুধু তার এজেন্ডা নিয়ে ওয়াসা বোর্ডে আলোচনা হবে এবং সিদ্ধান্তও হতে হবে তার মতো করে। তাকসিম সাহেব বলেন, তিনি প্রধান নির্বাহী। বোর্ডেরও প্রধান নির্বাহী। অথচ বোর্ডে তার কোনো ভোটাধিকার নেই। যে ব্যক্তির ভোটাধিকার নেই, তিনি যদি বলেন-আমি বোর্ডেরও প্রধান নির্বাহী, তাহলে সেটা কী করে সম্ভব?
যুগান্তর : সরকারের উপর মহলের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই এমডি দীর্ঘদিন ওয়াসায় আছেন বলে জনশ্রুতি আছে, আপনি কী মনে করেন?
গোলাম মোস্তফা : এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
যুগান্তর : পদ্মা যশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। এ প্রকল্পের বিষয়ে বোর্ডের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কি না?
গোলাম মোস্তফা : এ প্রকল্প যখন বাস্তবায়ন করা হয়, তখন আমি ছিলাম না। বাস্তবায়নের পরে আমি এসেছিলাম। আসার পর আমি দেখলাম, ৪৫ কোটি লিটার উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন শোধনাগার হওয়ার কথা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছে ২২/২৩ কোটি লিটার। বাকিটা আমরা পাচ্ছি না। কিন্তু এটা কেন হবে। ঢাকার মানুষ পানির কষ্টে থাকলেও এটা নিয়ে প্রশাসনের মাথাব্যথা আছে বলে আমার মনে হয় না।
যুগান্তর : আপনার সময়ে কোন কোন প্রকল্পে এমডি স্বেচ্ছাচার করেছেন?
গোলাম মোস্তফা : বিদেশি সহযোগিতাপুষ্ট বড় প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে বোর্ডের সঙ্গে খুব বেশি ইন্টার‌্যাকশন হয় না। এই প্রকল্পের ব্যাপারে বোর্ডে আসে তখন, যখন উচ্চস্তর থেকে প্রকল্পের ঠিকাদার ও কনসালটেন্ট সিলেকশন দেওয়া হয়। এর আগে বোর্ডে কিছুই আসে না। এমনকি প্রকল্প কখন শুরু করা হলো, তাও বোর্ডে আসে না। বলা হয়, এটা মন্ত্রণালয় দেখে। এটা আসলে ঠিক না। মন্ত্রণালয় দেখলেও এটা বোর্ড হয়ে যাওয়ার কথা। প্রথমে বোর্ডের অনুমোদন হবে, এরপর মন্ত্রণালয়ে যাবে। কিন্তু বোর্ডে কিছু আনা হয় না। যে কারণে প্রকল্পের ব্যাপারে বোর্ড তেমন কিছু জানতে পারে না। মন্ত্রণালয়ও এসব ব্যাপারে কিছুই দেখে না।
যুগান্তর : দুর্নীতি বন্ধে সরকার কিংবা মন্ত্রণালয়ের কোনো পদক্ষেপ আছে কি?
গোলাম মোস্তফা : ঢাকা ওয়াসার এ বিষয়গুলো নিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিন্তা করারও কেউ নেই। মন্ত্রণালয় এটা ভাবেও না। মন্ত্রণালয়কে বললে বলে, এটা বোর্ড দেখছে। কারণ, ঢাকা ওয়াসা বোর্ড পরিচালনা করে। অথচ বোর্ডে কিছু আনা হয় না। বোর্ডকে বাইপাস করে সবকিছু করা হয়। মন্ত্রণালয় দেখছে না, বোর্ডও দেখতে পারছে না। ফলে ঢাকা ওয়াসার এক ব্যক্তি যেভাবে চাইবে, সেভাবেই সব হবে।
যুগান্তর : তাহলে কি ঢাকা ওয়াসার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তাকসিম এ খান?
গোলাম মোস্তফা : হ্যাঁ, তা তো বটেই।
যুগান্তর : তিনিই (এমডি) যদি সব হন, বোর্ড সদস্যরা যদি কাজ না করতে পারেন, তাহলে বোর্ড ভেঙে দিয়ে পদত্যাগ করে সরে এলেন না কেন? এত বিলম্বে কেন প্রতিবাদ করছেন?
গোলাম মোস্তফা : বোর্ড ভাঙার ক্ষমতা আমাদের নেই। এটা সরকার ভাঙতে পারে। অনেক সদস্য বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তা করেছেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য কয়েকবার বোর্ড মিটিংয়ে আসার পর পরবর্তী সময়ে আসা বন্ধ করে দেন। আমি চেয়ারম্যান হিসাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তিনি বললেন, এখানে আমার যাওয়ার দরকার আছে? এখানে আপনারা কী করেন? এখানে যা করেন, এটার জন্য আমি যাব না। এখানে বোর্ডের কিছু করণীয় নেই। আমরা অনেকেই আলাপ করেছি, আমরা যদি সবাই বোর্ড থেকে পদত্যাগ করতে যাই, তাহলে এটা সরকারের জন্য বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হয়। এই সরকার তো আমাদেরই সরকার।
যুগান্তর : আপনি দায়িত্ব পালনকালে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ভেতর থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখেছেন কি?
গোলাম মোস্তফা : না, দেখিনি। আসলে ওয়াসা একটা অন্যরকম প্রতিষ্ঠান। এটা ওয়াসা আইনে চলে। এখানে সরকারের প্রত্যক্ষ নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ নেই। এটা বোর্ডের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বোর্ডকে বাইপাস করে, অন্ধকারে রেখে নানাভাবে কাজ করা হয়। বোর্ড সদস্যরা কেউই এখানে ফুলটাইম না। তারা এখানে আসবেন, বিভিন্ন ইস্যুতে মিটিং করবেন, সিদ্ধান্ত দেবেন, চলে যাবেন। তাদের বাইপাস করা হলে তারা বুঝতেও পারেন না। প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার মিটার কেনা হয়। পানি শোধনাগারের জন্য কেমিক্যাল লাগে। কোটি কোটি টাকার কেমিক্যাল কেনা হয়। এগুলো বোর্ড কিছুই জানে না।
যুগান্তর : এগুলো কেনার আগে বোর্ড সিদ্ধান্তের আইনি বাধ্যবাধকতা আছে কি?
গোলাম মোস্তফা : আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু তা এড়িয়ে যাওয়া হয়। আমরা জানতেই পারি না।
যুগান্তর : তাহলে ক্রয়সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে বোর্ডের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না বলছেন?
গোলাম মোস্তফা : আমি আবার বলি, বিদেশি সহযোগিতাপুষ্ট প্রকল্পগুলোয় নামকাওয়াস্তে বোর্ডের অনুমোদন নেওয়া হয়। উপস্থাপনের সময় জাস্ট বলা হয়, সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে আছে, এখন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পারচেজ কমিটিতে যাবে। তাই বোর্ডের অনুমোদন লাগবে। তখন বোর্ডের অনুমোদন দেওয়া ছাড়া কিছুই করার সুযোগ থাকে না। আর আইনে বলা আছে, নিজস্ব ফান্ড থেকে যে কাজ হবে, সেটা বোর্ডের মাধ্যমে সব অনুমোদন হবে। কিন্তু সেটাও বোর্ডে আনা হয় না।
যুগান্তর : দায়িত্বকালীন জনসেবায় আপনি কতটুকু কাজ করতে পেরেছেন?
গোলাম মোস্তফা : পানির সমস্যা সমাধানে আমরা তেমন কিছুই করতে পারিনি। আইনে আছে, প্রতিবছরের করণীয় ঠিক করে তা বোর্ডে উপস্থাপন করা। কিন্তু কোনোদিনই এটা করা হয় না। আমরা বলেছি। আমাদের কথা শোনে না। বোর্ডে বসে তো মারামারি করা যায় না।
যুগান্তর : যেহেতু আপনারা কোনো কাজ করতে পারেননি, তাহলে বিবেকের তাড়নায় জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় নেওয়া ভাতা আপনারা ফেরত দেবেন কি না?
গোলাম মোস্তফা : ভাতা ফেরত দেওয়ার চিন্তা করছি না। কারণ আমরা তো কাজ করেছি। অফিসে গিয়েছি। মিটিং করেছি। বরং বিভিন্ন অপকর্মে এমডিকে থামাতে আমাদের আরও বেশি সময় দিতে হয়েছে।
যুগান্তর : দুর্নীতি দমন কমিশন ওয়াসার দুর্নীতি নিয়ে মামলা করলে আপনারা রাজসাক্ষী হবেন কি না?
গোলাম মোস্তফা : মামলার বিষয়বস্তুতে যদি বোর্ডের সংশ্লিষ্টতা থাকে যেমন: বোর্ডের সিদ্ধান্ত অমান্য করে এমডি তাকসিম এ খান স্বেচ্ছাচার কায়দায় সব কাজ করেছেন, তাহলে আমার ধারণা বোর্ডের সবাই সাক্ষ্য দেবেন।
যুগান্তর : আপনি নিজে থেকে আর কিছু বলতে চান কি?
গোলাম মোস্তফা : না, আমার আর কিছু বলার নেই। আমার যা বলার ছিল, সবই মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলে দিয়েছি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/678407