১৩ মে ২০২৩, শনিবার, ১২:৩৩

ডিজিটাল হুন্ডিতে পাচার অর্ধশত কোটি টাকা

দেশ থেকে অর্থ পাচারের বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে ‘ডিজিটাল হুন্ডি’। সুরক্ষিত মোবাইল অ্যাপে যোগাযোগ এবং মোবাইল ব্যাংকিং সেবা (এমএফএস) ব্যবহার করে বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে প্রাপকের কাছে টাকা পৌঁছানো হচ্ছে। এতে প্রবাসীর স্বজন টাকা পাচ্ছেন ঠিকই, তবে হুন্ডি কারবারিদের কারসাজিতে বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে দেশ।

লোভনীয় কমিশনের বিনিময়ে কিছু এমএফএস এজেন্ট অনৈতিক এ কাজে সহায়তা করছেন। সম্প্রতি এমন তিন এজেন্টের লেনদেন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তিন বছরে তাঁরা প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা পাচার করেছেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।

সিআইডির সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, অর্থ পাচারকারীরা নানা কৌশল ব্যবহার করেন। এর মধ্যে হুন্ডি অন্যতম। এখন তাঁরা এমএফএস সার্ভিস ব্যবহার করে ডিজিটাল হুন্ডির কারবার চালাচ্ছেন। সম্প্রতি এ কারবারে জড়িত দুই বিকাশ এজেন্টকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে পুরো নেটওয়ার্ক বিষয়ে জানিয়েছেন। এমন আরও কিছু হুন্ডি কারবারির ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অসাধু কিছু এমএফএস এজেন্ট দেশ-বিদেশে অবস্থানরত অর্থ পাচারকারী চক্রের সঙ্গে মিলে বিদেশে অর্থ পাচার করছেন। হুন্ডি চক্রের বিদেশে অবস্থানরত সদস্যরা প্রবাসীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে দেশে না পাঠিয়ে নিজের কাছে রেখে দেন।

এ দেশে অবস্থানরত পাচারকারীরা তাঁদের সঙ্গে যোগসাজশে বিদেশে অর্থ পাচার করছেন। অর্থ পাচারকারী এজেন্টদের বিরুদ্ধে সিআইডি অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধান ও গোয়েন্দা তথ্যে জানা যায়, নোয়াখালীর চাটখিলের আদর্শ টেলিকম, বাবর টেলিকম ও নিউ শাড়ি গ্যালারি অ্যান্ড কসমেটিক্স নামে তিনটি প্রতিষ্ঠানের আড়ালে এমএফএস এজেন্টরা হুন্ডির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পাচার করে আসছেন। এর সঙ্গে জড়িত এজেন্ট শাহাদাৎ হোসেন ও বলাই চন্দ্র দাসকে গত ১৯ এপ্রিল চাটখিলের দক্ষিণ রেজ্জাকপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে অর্থ পাচারে ব্যবহৃত এজেন্ট সিমকার্ড, একটি ল্যাপটপ, সাতটি মোবাইল ফোন, পেনড্রাইভ, চেক বই, ব্যাংকের এটিএম কার্ড এবং ১৯ হাজার টাকা জব্দ করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্টন থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে।

শাহাদাৎ হোসেন সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তাঁর চাচা মনোয়ার হোসেন কাতারে থাকেন। মনোয়ার এবং সৌদি আরবে অবস্থানরত মিজান ও হংকংয়ে অবস্থানরত মমিনসহ বেশ কয়েকজন বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে তা বাংলাদেশে না পাঠিয়ে নিজেদের কাছেই রাখেন। এর পর হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমোর মাধ্যমে শাহাদাৎকে জানিয়ে দেন প্রাপকের নাম ও মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশে অবস্থানরত বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে টাকা পাঠিয়ে দিতেন শাহাদাৎ। এর আগেই তাঁর ব্যাংক হিসাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা চলে আসত। তাঁর দাবি, যাঁদের কাছে টাকা পাঠাতেন, তাঁদের তিনি চেনেন না।

তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, শাহাদাতের ব্যাংক হিসাবে কারা টাকা জমা দিতেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাচারকারীরা দেশে প্রাপকের কাছে হস্তান্তরের জন্য এজেন্টকে চাহিদামতো টাকা দেন। বিনিময়ে বিদেশে এই চক্রের সদস্যদের কাছে জমা থাকা প্রবাসীর বৈদেশিক মুদ্রা নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।

এজেন্টের লেনদেনের ওপর নজরদারি: মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশের করপোরেট কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম সমকালকে বলেন, আমরা কখনোই চাই না আমাদের প্ল্যাটফর্ম কোনো অবৈধ উদ্দেশ্যে ব্যবহার হোক। এ কারণে এজেন্টদের লেনদেনের ওপর প্রযুক্তিগতভাবে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হয়। এর ভিত্তিতে সন্দেহজনক গতিবিধি রিপোর্ট (এসএআর) ও সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট (এসটিআর) তৈরি করা হয়। সেগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউতে (বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) পাঠানো হয়। তারা সেগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়। একইভাবে বিকাশের পক্ষ থেকেও অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেওয়া বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর বাইরে কোনো সংস্থা যদি তথ্য বা সহায়তা চায়, তাও দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, বিকাশের কোনো এক্সক্লুসিভ এজেন্ট নেই। দেখা যায়, একজন এজেন্ট একই সঙ্গে সব এমএফএসের এজেন্ট। তবে বিকাশের গ্রাহক বেশি হওয়ায় লোকজন সব এমএফএস এজেন্টকে বিকাশ এজেন্ট হিসেবেই চেনেন।

https://samakal.com/bangladesh/article/2305172271