১২ মে ২০২৩, শুক্রবার, ১১:৪৬

খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলজুড়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা

খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলজুড়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। দুর্বল বেড়িবাঁধ উদ্বেগকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার উত্তর মহেশ্বরীপুর, গাতিরঘেরি ও কাটকাটা এলাকায় বাঁধ ধসে যাওয়ায় ঝুঁকিতে রয়েছে মানুষ। চলতি বছর বর্ষার আগেই কয়রার শাকবাড়িয়া নদী ও কপোতাক্ষ নদের প্রায় ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বিভিন্ন জায়গায় ধস দেখা দিয়েছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছেন পাঁচ ইউনিয়নের বাসিন্দারা। সাতক্ষীরার ঝাপালী বাজার থেকে ঘোলা খেয়াঘাট অভিমুখে বেড়িবাঁধের তিনটি স্থানের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। বিড়ালক্ষীতে দু’টি ও বড়কুপটের একটি জায়গা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

জানা গেছে, ৬ নম্বর কয়রা, ৪ নম্বর কয়রা রিং বাঁধ, ঘাটাখালী, হরিণখোলা, মদিনাবাদ লঞ্চঘাট-সংলগ্ন এলাকা, মঠবাড়িয়া, ২ নম্বর কয়রা, হোগলা, গাজীপাড়া, গোলখালী, হাজতখালী, জোড়শিং ও মহেশপুর এলাকার প্রায় ১২ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীতে পানি বাড়লে ওই এলাকার বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এ ছাড়া কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীতে পানি সরবরাহের আটটি জলকপাট (স্লুইসগেট) অকেজো পড়ে আছে। শাকবাড়িয়া নদীর নয়ানী ও সুতিয়া বাজার-সংলগ্ন জলকপাটটি নষ্ট হওয়ার উপক্রম। জলকপাটের দুই পাশের মাটি দেবে নদী থেকে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। শাকবাড়িয়ার হেমলতা মন্ডল বলেন, ‘আগে দুবার ভেঙেছে। পরে বড় বাঁধ দিলেও সেটিও কয়েক দিন আগে ভেঙে গেছে। বালু দিয়ে বাঁধ দেওয়ায় এ অবস্থা। আরেকটু হলে গ্রামে পানি ঢুকবে। ভাঙন তাদের নিঃস্ব করেই ছাড়বে।’

উত্তর মহেশ্বরীপুর সিংহেরচরের বিপ্রদাস মন্ডল বলেন, ‘কয়েকবারের ভাঙনে আমার ১১ বিঘা জমি নদীর পেটে চলে গেছে। এখন নতুন করে বাঁধে ধস দেখা দেওয়ায় ভিটেবাড়ি হারানোর শঙ্কায় রয়েছি।’

দক্ষিণ বেদকাশী ইউপির ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোজাফফর হোসেন বলেন, ‘ইউনিয়নের দুই পাশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে শাকবাড়িয়া ও কপোতাক্ষ। দুই নদ-নদীর ক্রমশ ভাঙনে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হতে যাচ্ছে ইউনিয়নটি। ১০ বছর আগেও দুই নদ-নদীর দূরত্ব দুই কিলোমিটারের বেশি ছিল। প্রতিবছর ভাঙতে ভাঙতে এখন ৩০০ মিটারে এসে ঠেকেছে।’

মহেশ্বরীপুর ইউপির ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মনি শঙ্কর রায় বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ও জলকপাট নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। পাউবো টালবাহানা করে কালক্ষেপণ করছে। উত্তাল নদী আর বৈরী আবহাওয়া দেখলেই এলাকার মানুষ ভয়ে থাকেন।’

মহেশ্বরীপুর ইউপির চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারি বলেন, ‘প্রতিবছর বাঁধ ভাঙছে। কেউ না কেউ নিঃস্ব হচ্ছে। বর্তমানে যে কয়েক জায়গায় বাঁধ ধসে গেছে, নদীতে জোয়ার বাড়লে বড় ক্ষতি হতে পারে। বাঁধ ভাঙলে গোটা ইউনিয়ন নদীর পানিতে তলিয়ে যাবে। বিষয়টি নিয়ে পাউবো কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার কথা হয়েছে।’

উত্তর বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের গাজীপাড়া ও গাতিরঘেরী এলাকায় নতুন প্রযুক্তিতে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বছর না ঘুরতেই সেই বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে।’

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এখন দৃশ্যমান। বেড়িবাঁধের উচ্চতা বাড়াতে না পারলে উপকূলীয় অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বাড়তেই থাকবে। কয়রার বাঁধগুলোর উচ্চতা আরও অন্তত ১০ ফুট বাড়ানো উচিত।’

পাউবো সূত্র জানায়, ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াসের পর উপজেলার ২১টি জায়গায় ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করা হয়। পাশাপাশি ২০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধে মাটি ও বালুর বস্তা ফেলে সংস্কার করা হয়। বর্তমানে সাত কিলোমিটারের বেশি সংস্কারকাজ চলমান। তবে এখনও ৯ থেকে ১০ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে।

পাউবো খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘তিন দিকে নদীবেষ্টিত কয়রা উপজেলার মূল সমস্যা নদীভাঙন। যেকোনও দুর্যোগে নদীতে জোয়ারের চাপ বাড়লে কোথাও না কোথাও ভাঙন ধরে। স্থায়ী সমাধানে বাঁধ নির্মাণের জন্য একটি মেগা প্রকল্প শুরু হবে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ঝুঁকি কমবে।’

সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ঝাপালী বাজার থেকে ঘোলা খেয়াঘাট অভিমুখে বেড়িবাঁধের তিনটি স্থান অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। সামান্য জলোচ্ছ্বাসে ওই বাঁধ ভেঙে যেতে পারে।’ আটুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবু সালেহ বাবু বলেন, ‘আটুলিয়া ইউনিয়নে তিনটি পয়েন্ট পাউবোর বেড়িবাঁধ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এরমধ্যে বিড়ালক্ষীতে দু’টি ও বড়কুপটের একটি জায়গা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।’

শ্যামনগরের পাউবোর সেকশন কর্মকর্তা (এসও) সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘শ্যামনগরে পাউবোর বেড়িবাঁধের অধিকাংশ ঝুঁকিপূর্ণ স্থান মেরামত সম্পন্ন হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলছে।’

শ্যামনগর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) শাহিনুল ইসলাম বলেন, ‘ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে প্রত্যেক ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের সাবধান থাকার কথা বলা হয়েছে।’

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আক্তার হোসেন বলেন, ‘ইতোমধ্যে প্রত্যেক ইউপি চেয়ারম্যান ও সিপিপি টিম লিডারদের সঙ্গে কথা হয়েছে। উপজেলার ১০৩টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করার জন্য বলা হয়েছে।’
এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবেলায় খুলনায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৪০৯টি সাইক্লোন শেল্টার। সার্বিক প্রস্তুতি নিতে বৃহস্পতিবার খুলনা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার জন্য ৪০৯টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত করা হচ্ছে, যাতে পরিস্থিতি অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ লোকজন সেখানে আশ্রয় নিতে পারেন। এসব সাইক্লোন শেল্টারে মোট ২ লাখ ৭৩ হাজার ৮৫০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবেন। তিনি জানান, সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বৃহস্পতিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি সভা হয়েছে। আবহওয়া অফিসের মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়ের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুল করিম জানান, উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। বিপদ সংকেত জারি হলে তারা এলাকায় মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করবেন। এছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে নিজ নিজ কর্মস্থলে থাকার জন্য বলা হয়েছে।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ আমিরুল আজাদ জানান, বর্তমানে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের যে গতিপথ রয়েছে, তা পরিবর্তন না হলে আপাতত ঘূর্ণিঝড় খুলনা উপকূলে আঘাত হানার আশংকা নেই। তবে ঝড়ের প্রভাবে হালকা বাতাস ও ভারী বৃষ্টি হতে পারে। ১৩ মে থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

https://dailysangram.info/post/524241