১১ মে ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১১:৩৩

ডলার সংকট, নাকি কৌশল

কয়েক মাস ধরেই বাড়তি দরে বেচাকেনা হচ্ছে চিনি। এর মধ্যে নতুন করে আবার পণ্যটির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আগেই বেড়েছে ভোজ্যতেলের দর। তেল-চিনির বাজারে যখন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি, তখন পণ্য দুটি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ভাসছে ১০ জাহাজ। এর মধ্যে ২১ দিন থেকে এক মাস পর্যন্ত অপেক্ষমাণ জাহাজও রয়েছে।

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও শিপিং এজেন্টগুলোর দাবি, ডলার সংকটের কারণে জাহাজ থেকে পণ্য নামানো যাচ্ছে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে বলা হয়েছে, ডলার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ডলার সংকটে পণ্য খালাস আটকে থাকার কথা নয়। ভোক্তা-সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলছেন, কৌশলী আমদানিকারকরা চিনির দাম বাড়ানোর অপেক্ষায় রয়েছেন। দাম বাড়লে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করবেন তাঁরা। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাড়তি দাম পাওয়ার আশায় আমদানিকারকরা পণ্য খালাসে দেরি করছেন কিনা, তাও খতিয়ে দেখা উচিত।

বন্দর সূত্রে জানা গেছে, পণ্যবোঝাই ১০ জাহাজ বহির্নোঙরে রয়েছে। তবে আমদানিকারকরা টাকাতে এলসি মূল্য পরিশোধ করলেও ডলার সংকটের কারণে বিদেশি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের দায় পরিশোধ করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। তাই মিলছে না পণ্য খালাসের ছাড়পত্র।

সম্প্রতি ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বাড়ানোর ব্যাপারে নিত্যপণ্য দুটির আমদানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। ওই বৈঠকে সাগরে পণ্যবোঝাই জাহাজ ভাসছে, পণ্যমূল্য অর্থাৎ আমদানিকারকরা বিদেশি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের দায় মেটাতে পারছেন না– এমন আলোচনাও হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি জানান, ব্যাংকে এলসি খোলা তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। নানাভাবে চেষ্টা বা অনুরোধ করে ছোট অঙ্কের কিছু এলসি খোলা যাচ্ছে। তবে ডলার সংকটে বিদেশি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের আমদানি দায় পুরোপুরি মেটানো যাচ্ছে না। ফলে আটকে রয়েছে পণ্য খালাস।

মেঘনা গ্রুপের সাড়ে ৬০ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি নিয়ে ১৭ এপ্রিল আসে জাহাজ ‘এমভি কুইন সাফাহার’। জাহাজটি থেকে এখনও পণ্য খালাস হয়নি। ৫৬ হাজার ১৯৩ টন, ৩৪ হাজার ৪০০ টন ও ১২ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল নিয়ে আসা আরও তিনটি জাহাজের খালাস কার্যক্রমও আটকে আছে। ২৬ হাজার ৮৩০ টন পোলট্রি ফিড নিয়ে আসা আরও তিন আমদানিকারকের জাহাজবোঝাই পণ্য সাগরে ভাসছে।

গত এপ্রিলে ৩০ হাজার টন চিনির কাঁচামালবোঝাই আব্দুল মোনেম গ্রুপের একটি জাহাজকে ডলার সংকটের কারণে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০ দিন। সাগরে এখন চিনিবোঝাই জাহাজ আছে তিনটি। এর দুটি এস আলম গ্রুপের। সাধারণত চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আসার পরপরই খালাস কার্যক্রম শুরু হয়। তাই আগেই খালাসের ছাড়পত্র দেয় বিদেশি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। তবে এলসির টাকা ডলারে বুঝে না পাওয়ায় এখন সেই ছাড়পত্র দিচ্ছে না তারা।

জানতে চাইলে এস আলম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) সুব্রত কুমার ভৌমিক সমকালকে বলেন, ‘এলসির টাকা পরিশোধ করলেও ডলারের সংকটে তা বিদেশি রপ্তানিকারককে পরিশোধ করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। এ কারণে কোনো কোনো চালান আটকে আছে।’
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিত সাহা এবং মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামালের সঙ্গে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করলেও তাঁরা সাড়া দেননি।

চট্টগ্রাম বন্দরের বার্থিং লিস্ট পর্যালোচনা করে সাগরে পণ্যবোঝাই ১০ জাহাজ থাকার কথা জানিয়েছে বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম বন্দরের শিপ হ্যান্ডলিং ও বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম শামসুজ্জামান রাসেল। তিনি বলেন, ‘সাগরে তেল ও চিনির বেশ কিছু জাহাজ রয়েছে। কিছু জাহাজ দেরিতে খালাস কার্যক্রম শুরু করেছে। আর কিছু জাহাজ এখনও অলস বসে আছে।’

মেঘনা গ্রুপের ‘এমভি কুইন সাফাহার’
সাড়ে ৬০ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি নিয়ে ‘এমভি কুইন সাফাহার’ জাহাজটি বন্দরে আসে ১৭ এপ্রিল। জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট ইউনাইটেড শিপিংয়ের পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, মেঘনা গ্রুপের চিনিবোঝাই জাহাজটি পণ্য খালাস করতে পারেনি এখনও। এরই মধ্যে গত সোমবার ৫৪ হাজার ৩২৩ টন সয়াবিনের কাঁচামালবোঝাই আরেকটি জাহাজ এসেছে। একই শিপিং লাইনের আরেক কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘বিদেশি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমতি না পাওয়ায় পণ্য খালাস শুরু করা সম্ভব হয়নি। তবে সয়াবিনের বীজবোঝাই জাহাজের পণ্য ওই দিনই খালাস শুরু হয়েছে।’

সিটি গ্রুপের ‘এমভি কমন এটলাস’
৫৬ হাজার ১৯৩ টন সয়াবিনের বীজ নিয়ে এসে সাগরে ভাসছে সিটি গ্রুপের জাহাজ ‘এমভি কমন এটলাস’। গত সোমবার বন্দরে নোঙর করলেও পণ্য খালাসের অনুমতি পায়নি। জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট সেইফ শিপিংয়ের পরিচালক আনোয়ার জাবেদ বলেন, ‘ডলারে এলসি মূল্য বুঝে না পাওয়ায় বিদেশি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান পণ্য খালাসের ছাড়পত্র দেয়নি। এ কারণে পণ্য খালাসে দেরি হচ্ছে।’

আরবি গ্রুপ ও মাহবুব গ্রুপের ‘এমভি জিন হাই টনে’
ব্রাজিল থেকে সয়াবিনের বীজ নিয়ে আসা ‘এমভি জিন হাই টন’ জাহাজটি ভাসছে সাগরে। জাহাজটিতে রয়েছে আরবি গ্রুপ ও মাহবুব গ্রুপের পণ্য। সোমবার চট্টগ্রাম বন্দর সীমায় নোঙর করলেও এটির খালাস প্রক্রিয়া কবে শুরু হবে, তা জানে না স্থানীয় শিপিং এজেন্ট এশিয়া বাল্ক মেরিটাইম। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন মজুমদার বলেন, এলসি নিষ্পত্তি না হওয়ায় পণ্য খালাসের অনুমতি দিচ্ছে না রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান।

পোলট্রি ফিড আটকে আছে ‘এমভি এইচটিসি সানরাইজে’
‘এমভি এইচটিসি সানরাইজ’ নামে একটি জাহাজ তিন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের পোলট্রি ফিড নিয়ে নোঙর করে গত ২৬ এপ্রিল। পাঁচ দিন অপেক্ষার পর কিছু পণ্য খালাসের ছাড়পত্র পান তাঁরা। তবে এলসি মূল্য পরিশোধ না করায় ২ হাজার ৬০০ টন পণ্যের ছাড়পত্র দেয়নি বিদেশি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। এই জাহাজে থাকা পণ্যের আমদানিকারক হচ্ছে সিটি বাংলাদেশ, নিও হোফ এগ্রো ও কাজি ফার্ম।

‘এমভি ডিএমসি নেপচুন’ থেকে হচ্ছে না সয়াবিন খালাস
‘এমভি ডিএমসি নেপচুন’ জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট মাল্টি পোর্ট শিপিং। এতে আছে ১২ হাজার টন সয়াবিন তৈরির কাঁচামাল। ৬ মে নোঙর করলেও পণ্য এখনও খালাস হয়নি। মাল্টি পোর্ট শিপিংয়ের পরিচালক মাহমুদুল হাসান বলেন, কিছু পণ্যের খালাসে অনুমতি মিললেও বাকিগুলোর ছাড়পত্র আসেনি। পণ্য আমদানি করেছে নারিস এগ্রো। ৩৪ হাজার ৪০০ টন সয়াবিনের কাঁচামালবোঝাই ‘এমভি লরেন্স জর্জ’ নামের আরেকটি জাহাজ বন্দরে নোঙর করেছে ১০ এপ্রিল। এই জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট আইএমএস শিপিং। এ জাহাজেরও সব পণ্য খালাস হয়নি।

১৫ দিন পর খালাস শুরু ‘এমভি লরেন্স জর্জে’
৩৪ হাজার ৪০০ টন সয়াবিন তেলের কাঁচামালবোঝাই ‘এমভি লরেন্স জর্জ’ নামের আরেকটি জাহাজের পণ্য খালাসে দেরি হচ্ছে ডলার সংকটে। জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট আইএমএস শিপিং। তবে তাদের হয়ে পণ্য খালাস করছে বার্ডস বাংলাদেশ। এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সৈয়দ মাহমুদুল আহসান বলেন, ‘জাহাজটি এসেছে এক মাস আগে। পণ্য খালাসে ১০ থেকে ১২ দিন লাগার কথা। ব্যাংক দায় পরিশোধ করতে দেরি করেছে, তাই ১৫ দিন পর খালাস শুরু হয়।’

এস আলমের চিনি ‘এমভি এমিরা মিরোতে’
এস আলম গ্রুপের ৫০ হাজার টন চিনি তৈরির কাঁচামাল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে ‘এমভি এমিরা মিরো’ জাহাজটি। গত সোমবার জাহাজটি নোঙর করেছে। একই গ্রুপের ৫২ হাজার ৫০০ টন অপরিশোধিত চিনিবোঝাই আরও একটি জাহাজ আছে বন্দরে। ২৫ এপ্রিল নোঙর করা এই জাহাজের খালাস কার্যক্রম এখনও শেষ হয়নি। জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট প্যাসিফিক শিপিংয়ের কর্মকর্তা মো. শরীফ বলেন, ‘এখনও ১০ হাজার টন চিনি খালাস হয়নি। এটির খালাস শেষ হলে গত সোমবার নোঙর করা আরেকটি জাহাজ থেকে পণ্য খালাস শুরু হবে।’ গত রোববার ৩০ হাজার টন চিনি তৈরির কাঁচামাল নিয়ে ‘এমভি হং সিন ওসান’ নামে আরেকটি জাহাজ বন্দরে এসেছে। এই জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট ব্যানকন শিপিং।

কারা কী বলছেন
শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম জুয়েল বলেন, একেকটি জাহাজকে নাবিক ক্রুদের বেতন ও জ্বালানিসহ প্রতিদিন খরচ গুনতে হয় অন্তত ২০ থেকে ৩০ হাজার ডলার। এভাবে ডলার সংকটে জাহাজ দিনের পর দিন অপেক্ষা করলে দেশেরও সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। জরুরি ভিত্তিতে এ পরিস্থিতির সমাধান দরকার। অন্যথায় বাংলাদেশে জাহাজ পাঠাতে অতিরিক্ত সারচার্জ আরোপ হতে পারে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ডলার সংস্থান করার পর যাতে ব্যাংক এলসি খোলে, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে। ফলে এখন অনেক আমদানিকারকের এলসি খুলতে না পারার ঘটনা ঘটলেও একবার এলসি খোলার পর ডলার সংকটজনিত কারণে পণ্য খালাস করতে না পারার কথা নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, মাঝে ব্যাংকগুলোর ডলারের নেট ওপেন পজিশন (এনওপি) ৬০ কোটি ডলার নেগেটিভ হয়েছিল। আমদানি কমানোসহ বিভিন্ন কারণে এখন তা ১৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার ইতিবাচক। আবার ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে ৩৩৬ কোটি ডলার। ফলে এ সময়ে ডলার সংকটে দায় পরিশোধে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তারা জানান, কৃত্রিম সংকট তৈরি কিংবা বেশি দামে পণ্য বিক্রির জন্য অনেক সময় আমদানিকারকের ইচ্ছা করেই পণ্য খালাসে দেরি করার কথা শোনা যায়। অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে দর বাড়বে– এমন খবরে এলসি না খুলেই পণ্য নিয়ে আসেন। এ রকম ঘটলে ব্যাংকগুলো দায় নিতে চায় না। এ ক্ষেত্রে কী ঘটেছে, খবর নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংকগুলোতে ডলার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সব সময়ই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিত্যপণ্যের এলসি খুলতে বলা হয়েছে। ফলে ডলার সংকটের কারণে বন্দরে জাহাজ আটকে থাকার কথা না।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা কখনও ক্ষতির টাকা নিজের পকেট থেকে দেয় না; বরং দ্বিগুণ হারে আদায় করবে ভোক্তার পকেট থেকে। তাই ডলার সংকটের সুরাহা হওয়ার দরকার জরুরি ভিত্তিতে। তবে বেশি দাম পাওয়ার আশায় আমদানিকারকরা কৌশলে পণ্য খালাসে দেরি করছে কিনা, সেটিও খতিয়ে দেখা উচিত।’

এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ সমকালকে বলেন, দুটি কোম্পানি এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছে। তবে বিল পরিশোধের বিষয়ে কেউ এখন পর্যন্ত আবেদন করেনি। আমদানিকারকদের বলতে হবে পণ্য খালাস না করলে বাজারে সমস্যা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রয়োজনে বিদেশি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করা হবে এবং সময়মতো যেন দায় মেটাতে পারে, সে জন্য সহযোগিতা করা হবে।

https://samakal.com/bangladesh/article/2305171926